ভোটের মাঠে তারকাদের জয়-পরাজয়
প্রকাশ | ০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বিনোদন রিপোর্ট
বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই সর্বপ্রথম এমন একটি ঘটনা ঘটল যেখানে শোবিজের হেভিওয়েট তারকাদের অংশগ্রহণ ছিল তাক লাগানোর মতো। ফলে দেশের আপামর মানুষের কাছে এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অন্যতম আলোকিত বিষয় ছিল তারকা শিল্পীরাই সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে আগে থেকেই ধারাবাহিকভাবে ছিলেন আসাদুজ্জামান নূর আর মমতাজ বেগম। তবে তাদের দিক থেকে সেই ফোকাসটা সরে গিয়ে সব আলো যেন উপচে পড়েছিল এবার প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদে বসার লক্ষ্যে মাঠে নামা নায়ক ফেরদৌস, নব্বই দশকের শ্রোতাপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ডলি সায়ন্তনী আর ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির 'অগ্নিকন্যা'খ্যাত নায়িকা মাহিয়া মাহী।
যদিও মাঠে শক্ত কোনো বিরোধী দলের প্রার্থী ছিল না তারপরও এবারে ভোটের মাঠে অক্লান্ত শ্রম আর একাগ্রতায় হাটে-মাঠে-সমাবেশে পাওয়া গেছে এই তারকাদের। নিশ্চিত বিজয় বুঝে কেউ ঘরে বসে থাকেননি। চলচ্চিত্রের কাজ ফেলে মাঠে-ঘাটে, হাটে সকাল-সন্ধ্যা চষে বেড়িয়েছেন তারা। নায়িকা মাহিয়া মাহী যেন রাতের ঘুমও বাতিল করে দিয়েছেন এই নির্বাচনী প্রচারণা করতে গিয়ে। ধারণা করা হচ্ছিল, পুরনো তারকাদের বহরে এবার যুক্ত হবেন আরও কয়েকজন। সংসদে ভারী হবে শিল্প-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পালস্না।
তবে দিনভর ভোটগ্রহণ শেষে অনেকটাই সেই প্রত্যাশায় গুড়েবালি পড়েছে। নতুনরা তো হতাশ করলেনই, পুরনো সম্ভাব্য জয়ী প্রার্থী দেশের বিপুল শ্রোতাপ্রিয় ফোকসম্রাজ্ঞীখ্যাত তারকা শিল্পী মমতাজ বেগমও হেরে গেলেন মাত্র কয়েকটি ভোটের ব্যবধানে। যা তার ভক্তদের জন্য ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। অপ্রত্যাশিত হয়তো তার দলটির কাছেও। সে ক্ষেত্রে এবারের নির্বাচনে তারকাদের মধ্যে বড় চমক হয়ে শেষ হাসি হাসলেন 'হঠাৎ বৃষ্টি'খ্যাত দুই বাংলার মহানায়ক ফেরদৌস। যেন সেই সংলাপের মতোই- এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। রোববার (৭ জানুয়ারি) রাতে শেষ খবর আসা পর্যন্ত বেসরকারি সূত্রে পাওয়া তারকাদের ভোটের তথ্যগুলো থেকে জানা গেছে, নীলফামারী-২ (সদর) আসনে জয়ী হয়েছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব 'বাকের ভাই'খ্যাত আসাদুজ্জামান নূর। এ নিয়ে টানা পঞ্চমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন তিনি। রোববার রাতে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ এই ফল ঘোষণা করেন।
এতে দেখা গেছে, আসাদুজ্জামান নূর ১ লাখ ১৯ হাজার ৩৩৯ ভোট পেয়ে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়নাল আবেদীন পেয়েছেন মাত্র ১৫ হাজার ৬৮৪ ভোট।
নীলফামারী-২ আসনে মোট ভোটকেন্দ্র ছিল ১৩৫টি। মোট ভোটার ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৭৯ হাজার ৭১৮ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৭৯ হাজার ৭৩ জন।
এদিকে রাজশাহী-১ আসন থেকে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। ভোটের মাঠে তিনি অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। শুরু থেকেই দারুণ সচল থাকা এই অভিনেত্রী নির্বাচনের ফলাফলে এসে দেখলেন তার ব্যালট বাক্স ফাঁকাই পড়ে রইল। দিনশেষে তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন।
এই আসনে ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৪০ হাজার ২১৮ জন। ১৫৮টি কেন্দ্রের ফলাফল গণনা শেষে দেখা গেছে, মাহিয়া মাহী মাত্র ৯ হাজার ৯টি ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। অর্থাৎ নির্বাচিত হওয়া নৌকা প্রার্থীর সঙ্গে নূ্যনতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়তে পারল না তার ফিল্মি তারকা ইমেজ।
তবে এমন একটা ফল আসবে এটা হয়তো তিনি নির্বাচনের মাঠেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই ভোটগ্রহণের দিনই তিনি বলেন, 'ফল যা হওয়ার তাই হবে। আমি হারি আর জিতি, যা-ই ঘটুক ইনশাআলস্নাহ আগামীকাল (আজ) পুরো এলাকায় একটা শোডাউন দেব। হেরে গেলেও সবাইকে জানান দেব- আমি তাদের সঙ্গে আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব।'
মাহী বলেন, 'আমি রাজশাহী-১ আসনের সব গ্রাম ও জনপদে গেছি। এমনকি চরাঞ্চলেও গেছি। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। মানুষের কষ্টের কথাগুলো শুনেছি। এর থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। তাদের জন্য আমার অনেক করণীয় আছে। আমি যেখানেই থাকি, তাদের জন্য কিছু করব ইনশাআলস্নাহ।'
এই আসন থেকে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের ওমর ফারুক চৌধুরী। তিনি পেয়েছেন সর্বোচ্চ ১ লাখ ৩ হাজার ৫৯২ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কাঁচি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম রাব্বানী পেয়েছেন ৯২ হাজার ৪১৯ ভোট।
অন্যদিকে মানিকগঞ্জ-২ (সিঙ্গাইর, হরিরামপুর ও সদরের একাংশ) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী (ট্রাক প্রতীক) দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলুর কাছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে হেরে গেলেন তিনবারের এমপি কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম। ভোটের এমন লড়াই সম্ভবত এবারের নির্বাচনে আর কোনো আসনে ঘটেনি।
রোববার বেসরকারিভাবে ঘোষিত ফল অনুযায়ী এ আসনে মোট ১৯৩টি ভোটকেন্দ্রে ট্রাক প্রতীকের দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু পেয়েছেন ৮৪ হাজার ৫২৫ ভোট। মমতাজ বেগম পেয়েছেন ৭৮ হাজার ২৬৯ ভোট। মাত্র ৬ হাজার ২৫৬ ভোট বেশি পেয়ে দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলু বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন।
এদিকে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েই চমক দেখিয়েছেন ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক ফেরদৌস আহমেদ। ঢাকা-১০ আসনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে জিতেছেন তিনি। পেয়েছেন ৬৫ হাজার ৮৯৮ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ন্যাশনাল পিপলস পার্টির প্রার্থী শামসুল আলম আম প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন মাত্র ২ হাজার ২৫৭ ভোট।
রোববার ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে বিভাগীয় কমিশনার ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. সাবিরুল ইসলাম ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান। এই আসনে ভোট পড়েছে ২১.৭৮ শতাংশ।
অন্যদিকে পাবনা-২ আসন থেকে প্রথমবার নির্বাচন করেন কণ্ঠশিল্পী ডলি সায়ন্তনী। তিনি একটি নতুন দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) প্রার্থী ছিলেন। সেক্ষেত্রে বলা চলে, তারকা শিল্পীদের মধ্যে তিনি যতটা না দলের পরিচয়ে প্রার্থী হয়েছেন ততধিক বড় পরিচয় হলো তিনি নিজের পরিচয়েই দলের প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু এই পরিচয়ও তার কোনো কাজে এলো না। রোববার রাতে ঘোষিত ফলাফলে দেখা যায় ডলি সায়ন্তনী পেয়েছেন মাত্র ৪ হাজার ৩৮২ ভোট। তবে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগেই তিনি নির্বাচন বর্জন করেন।
এই আসনে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ফিরোজ কবির। তিনি পেয়েছেন ১ লাখ ৬৫ হজার ৮৪২ ভোট।
এবারের নির্বাচনে তারকা প্রার্থীদের মধ্যে সর্বনিম্ন ভোট কাস্ট করে হতাশ করলেন গায়িকা ডলি সায়ন্তনী! আর তীরে এসে তরী ডুবিয়ে সর্বোচ্চ অঘটন ঘটালেন মমতাজ বেগম। অন্যদিকে 'পুরনো চাল ভাতে বাড়ে' প্রকল্পের শক্তিমান অংশীদার হয়ে ফের দেখিয়ে দিলেন বর্ষীয়ান অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। ফেরদৌস তো অভিষেকেই হাঁকালেন সীমানা ছাড়িয়ে গ্যালারিতে পড়া ছক্কা।
তবে পরাজিত হলেও ভোটের মাঠে প্রতিপক্ষের গুগলি বলে পা পেঁচিয়ে বোল্ড আউট হওয়া মাহিয়া মাহীর বিরামহীন চেষ্টাটাও ভবিষ্যতের জন্য দারুণ এক উদাহরণ হয়ে থাকবে আগামী তারকা প্রার্থীদের মধ্যে।