জ্যেষ্ঠ শিল্পীরা ইউটিউবে সাড়া পাচ্ছেন কম
প্রকাশ | ০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মাতিয়ার রাফায়েল
নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে নতুনরা নিজেদের যতটা দ্রম্নত খাপ খাইয়ে নিতে পারে জ্যেষ্ঠরা সেখানে অনেকটাই আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে যেন অস্বস্তিতে ভোগেন তারা। প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যুগের পালেও যেভাবে নতুন হাওয়া এসে লাগে তাতে নতুনরাই বেশি উদ্বুদ্ধ হয় পুরনোরা সেভাবে নয়। এভাবেই এক যুগ থেকে আরেক যুগ বদলে যায়। এই বদলে যাওয়ার মধ্যে গানের পরিবর্তনটিই বেশি বোঝা যায়। একটা সময় গ্রামোফোন রেকর্ড বা কলের গান, রেডিও, ক্যাসেট এরকম কয়েকটি ধারা পেরিয়ে সর্বশেষ এলো ইউটিউব।
যারা গ্রামোফোন রেকর্ড বা কলের গানে অভ্যস্ত ছিলেন তারাও শুরুতে ক্যাসেট পেস্নয়ারের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারছিলেন না। মনে করতেন, গ্রামোফোন রেকর্ডেই গানের সুর ও কথা কানে শুনতে বেশি আরাম লাগে। ক্যাসেট পেস্নয়ারে সেটা কেমন ক্যাচক্যাচানির মতো লাগে। তারপরেও নতুনদের পছন্দের জন্য ক্যাসেট পেস্নয়ারের জোয়ারে কলের গান টিকতে পারেনি। একপর্যায়ে সেটা জাদুঘরেই চলে গেল। এরপর এলো ইউটিউব।
এ মাধ্যমটিতে শোবিজের সবকিছুরই রয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার তোপেই এক সময়ে গানের জগতে রাজত্ব করা ক্যাসেট পেস্নয়ারও হারিয়ে গেল। মিউজিক ভিডিও দখল করে নিল ক্যাসেট পেস্নয়ারের জায়গা। এটা ক্যাসেট পেস্নয়ারের জায়গা এমনভাবেই দখল করে নিল যে, বলতে গেলে জ্যেষ্ঠ শিল্পীরা তাতে সুবিধা করে উঠতে পারছেন না। কারণ, এই মাধ্যমটি শুধু তরুণদেরই অবাধ বিচরণভূমি হয়ে উঠেছে।
অথচ এই পাঁচ/সাত বছর আগেও বাংলাদেশের গানের সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রি ছিল পুরান ঢাকা। পাটুয়াটুলী আর নবাবপুর এলাকা ঘিরে ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গানের ইন্ডাস্ট্রি। ঈদ এলেই শত শত নতুন গানের অ্যালবামের গন্ধে মৌ মৌ করত এই এলাকা। দেশের অডিও বাজার নিয়ন্ত্রণ হতো এই এলাকা থেকেই। এখন বিগত কয়েক বছরের মধ্যেই কোথায় হারিয়ে গেল সেই সরগরম বাজার? দেয়ালে দেয়ালে দেখা যাচ্ছে না কেন আর নতুন অ্যালবাম ও তার পোস্টারের ছড়াছড়ি, থরেথরে সাজানো ক্যাসেট আর সিডির সম্ভার? কোথায় গুটিয়ে গেল অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো? কয়েক বছর আগেও ক্যাসেট সিডি বেচাকেনা হতো, এখন সেখানে মোবাইল, মেমোরি কার্ড, ঘড়ি, কাপড়ের দোকানসহ নানা হাবিজাবি বিপণনের দোকান।
জানা গেছে, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাইকারি অডিও বাজার চট্টগ্রামের চিত্র একই। রেয়াজউদ্দিন বাজারের শীর্ষস্থানীয় অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আমিন স্টোর, বিনিময় স্টোর, জাহেদ ইলেকট্রনিকস, ন্যাশনাল ইলেকট্রনিক, শাহ আমানত অডিও কমপেস্নক্স গানের অ্যালবামই বের করে না এখন। অনেক নামি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কেউবা অন্য ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। জানা গেছে, ছোট ও মাঝারি সবগুলো প্রতিষ্ঠানই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই কেন এমন বদলে গেল দেশের সমগ্র অডিও বাজার? কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পেল না কীভাবে দেশের সর্ববৃহৎ অডিও ইন্ডাস্ট্রি ঘিরে জমে ওঠা লাখ লাখ অ্যালবাম হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল ছোট ছোট পানের দোকানে, মুদি দোকানে, হোটেলে, রেঁস্তোরায় একটানা বেজে চলা সারা দিনরাত বাতাসে ভেসে বেড়ানো বাংলা ও হিন্দি গানের নানা সুরতরঙ্গ। অত্যন্ত নীরবেই যেন দখল করে নিল আন্তর্জাতিক পস্ন্যাটফরম ইউটিউব এই স্থানীয় গানের বাজার। কথায় বলে, 'কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ'। এক ইউটিউবের জন্যই এখন পথচলতিতে জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের কণ্ঠে শোনা যায় না কালজয়ী গানগুলো আর। এভাবেই দেশের গোটা অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে ঘটে গেছে যেমন সর্বনাশ তেমনি জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের কণ্ঠে কালজয়ী গানগুলো শোনা যায় না বলে নতুন প্রজন্মের শিল্পীরাও উদ্বুদ্ধ হতে পারছে না ভালো গানে কণ্ঠ দিতে।
এ নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় নতুন ও পুরাতন বেশ কয়েকজন গানের শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে বর্তমান ইউটিউব কেন্দ্রিক গানের বাজার ও আগেকার অডিও ইন্ডাস্ট্রি কেন্দ্রিক গানের বাজারের ভালো-মন্দ দিকের নানা কথা। তার মধ্যে নতুন শিল্পীদের প্রায় সবাই বর্তমান ইউটিউব কেন্দ্রিক গানের বাজারকে স্বাগত জানালেও পুরাতন শিল্পীদের প্রায় সবাই এ নিয়ে তাদের হতাশার কথা ব্যক্ত করেছেন।
দেশের বরেণ্য গায়ক সৈয়দ আবদুল হাদি বর্তমান ইউটিউব কেন্দ্রিক গানকে ভাইরালের নামে 'বিশেষত্বহীন চমকচর্চা' বলে অভিহিত করছেন। কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন বর্তমান অডিও বাজারের অবস্থায় হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, 'বর্তমান ইউটিউবে গান হচ্ছে কোথায়? আগে অডিও শিল্পকে কেন্দ্র করে একটা অ্যালবাম রিলিজের জন্য যে আয়োজন থাকত ইউটিউবে সেটার সুযোগ কোথায়? এখানে তো যে যেভাবে পারছে গানের নামে যাচ্ছেতাই ছেড়ে দিচ্ছে।'
কণ্ঠশিল্পী সামিনা চৌধুরী বলেন, আগে নতুন কোনো আনকোড়া কোনো গায়ক যেখানে সহজে কোনো অ্যালবাম প্রকাশ করতে পারত না এখন ইউটিউবে যে কেউ যে কোনো যাচ্ছেতাই গান প্রকাশ করতে পারছে। এতে গানের শৈল্পিক গুরুত্ব হারিয়ে যাচ্ছে।
খান আসিফুর রহমান আগুন বলেন, 'কিছু করার নেই। আজকালকার গানে মেলোডিই কমে গেছে। আসলে রুচিটাই বদলে গেছে মানুষের। রুচির গভীরতা কমে গেছে। সুরের গভীরতা কমে গেছে। বেশির ভাগ গানের কথায়ও কোনো আগা মাথা নেই। ভালো গাইড না পেলে এমনই হয়। ক্যাসেট এবং ইউটিউব- দুটোর পরিবেশনার ধরনও দু'রকম। তারপরও ভালো লাগার হিসেবে আমি অডিও ইন্ডাস্ট্রিটাকেই বেশি প্রাধান্য দেব। কারণ, অ্যালবামে একসঙ্গে দশ বারোটি গান প্রকাশ হতো আর ইউটিউবে তা একটা করে প্রকাশ করতে হচ্ছে। এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনার মতো। আর একসঙ্গে দশ বারোটি গান প্রকাশ হওয়া মানে একটা বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। আর ইউটিউবের গান মানুষ তো মনোযোগ দিয়ে শোনেও না।'
অন্যদিকে কুমার বিশ্বজিতের ভাষ্যমতে ইউটিউবের গান যেন দু'মাথাঅলা মানুষের গান। এক মাথা দিয়ে গানের কথা শুনছে অথবা শুনছে না আবার আরেক মাথা দিয়ে সেই গানের কল্পনায় ভেসে যাচ্ছে নানা রং-বেরংয়ের চিত্রে ও নৃত্যের অঙ্গভঙ্গিতে।