২০২৩ সালে ঢাকাই সিনেমার বছর শুরু হয়েছিল ফুল অ্যাকশন ও থ্রিলার সিনেমা দিয়ে। ১৩ জানুয়ারি 'বস্ন্যাক ওয়ার : মিশন এক্সট্রিম ২ নামের সিনেমা দিয়ে বছর শুরু হয়েছিল। এরপর বেশির ভাগ সিনেমাই ছিল সামাজিক ও প্রেম-রোমান্স ধর্মী সিনেমা। এবার নতুন বছরে জাতীয় নির্বাচন থাকায় সিনেমা একটু দেরিতে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে। ১৯ জানুয়ারি মেহেদী হাসানের 'শেষ বাজি' সিনেমার মুক্তি দিয়ে শুরু হবে নতুন বছরের। এই সিনেমাটি থ্রিলার ঘরানার। মানুষের জীবনে জুয়াখেলার প্রভাব নিয়ে গড়ে উঠেছে থ্রিলার ঘরানার সিনেমা 'শেষ বাজি'র কাহিনী।
শেষ বাজি'র নায়ক সাইমন সিনেমাটি নিয়ে বলেন, এখন তো সিনেমার গল্পের সময় বদলেছে। দর্শক পর্দায় ভিন্ন আভাস চায়। এই সিনেমার গল্পটিও তেমন। কাজটি যত্ন ও সময় নিয়ে করেছি। আশা করি, বছরের শুরুতে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি দর্শকদের ভালো লাগবে।
বর্তমান বিশ্বে অ্যাকশন ও থ্রিলার সিনেমাতেই যেমন সর্বোচ্চসংখ্যক সিনেমাপ্রেমী থাকে আবার তার রুচিও খুব দ্রম্নত বদলাতে থাকে। কারণ, অ্যাকশন ও থ্রিলার ঘরানার সিনেমাতে দর্শক এখন সমসাময়িক ঘটনাবলীর গল্পই বেশি দেখতে চায়। সে জন্য নির্মাতাদেরও ভিন্ন ট্র্যাকের গল্পের জন্য সবসময় পেরেশান থাকতে হয়। 'শেষ বাজি' সিনেমাটিও সেই ধাঁচের।
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে এখন অ্যাকশন সিনেমার চেয়ে থ্রিলার এবং প্রেম-রোমান্সের সামাজিক ঘরনার সিনেমাতেই ঝুঁকছেন নির্মাতারা। কারণ, এ ধরনের সিনেমা মাঝামাঝি বাজেটেই নির্মাণ করা যায়। তবে কি বাজেটের কারণেই বাংলাদেশে এখন অ্যাকশন সিনেমা নির্মাণের ঝোঁক কমে গেল? অথচ গত কয়েক বছরে বিশ্বে রক্তে শিহরণ জাগানো অনেক বিশাল বিশাল বাজেটের অ্যাকশন সিনেমা হয়েছে। যেমন- মিশন ইম্পসিবল, গস্নাডিয়েটর, পুলিশ স্টোরি, ধূম-২, অবতার, দি ম্যাট্রিক্স, কুং ফু হ্যাসেল, অপারেশন রেড সী, ইন্টারন্যাল অ্যাফেয়ার, টার্মিনেটর টু, জুরাসিক ওয়ার্ল্ড, অ্যাভেঞ্জার্স সিরিজ, জন উইক সিরিজ, জেমস বন্ড সিরিজ, দ্য গ্রেট ওয়াল, ক্রাউচিং টাইগার, হিডেন ড্রাগন, রিং অফ ডেথ, রেম্বো প্রভৃতি।
কিন্তু ঢাকাই সিনেমায় যেন অ্যাকশন সিনেমার গল্প বড়ই সংকট চলছে এখন। সামাজিক, প্রেম-রোমান্সের গল্প তৈরিতে যেমন সময় লাগে না, মস্তিষ্ক সামান্য উর্বল হলেই হয়ে যায়, অ্যকশন সিনেমায় ঠিক সে রকম। সেখানে অনেক মেধা ও বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন হয়। ঢাকাই সিনেমা গত কয়েক বছরে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উপজীব্য করে অ্যাকশন সিনেমা বানানো হয়েছে। এর মধ্যে কোনোটি সফল হলেও সবগুলো সফল হয়নি। বরং ব্যর্থই হয়েছে বলতে গেলে। ফলে এখন আর কেউ পুলিশকে উপজীব্য করে অ্যাকশন সিনেমায় ঝুঁকতে চাইছেন না। ফলে এ বছর হয়ত তেমন পুলিশি অ্যাকশন সিনেমা দেখা যাবে না। তবে আমাদের দেশে পুলিশকে একতরফা উপজীব্য করে সিনেমা নির্মাণে ঝুঁকি থাকায় আগে নির্মাতারা এ নিয়ে চিন্তা করেননি। তবে বিশ্বে বহু সিনেমাতেই পুলিশকে উপজীব্য করে সিনেমা হয়েছে। যেমন দেখা গেছে- চাইনিজ অ্যাকশন সিনেমা 'পুলিশ স্টোরি'তে। গল্পের চাহিদা অনুযায়ী, অ্যাকশন সিনেমার বাজেটও মাঝারি থেকে বিশাল। হলিউড অ্যাকশন সিনেমা মিশন ইম্পসিবল এবং বলিউড অ্যাকশন সিনেমা ধূম-২ যখন হয় তখনকার প্রেক্ষাপটে সেই বাজেট বিশাল। সাফল্যও বিশাল।
উন্নত দেশের অ্যাকশন সিনেমায় যে রকম টেকনোলজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট থাকে ঢাকাই ফিল্ম এখনো প্রায় শিশু। তবে গত কয়েক বছরে অন্তত আগের চেয়ে উৎকৃষ্ট কালারিং এডিটিং গ্রাফিক্স ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে। তবে গল্পই সে অনুপাতে আগাতে পারছে না। নির্মাতারা ভারত থেকে উন্নত প্রযুক্তি ক্যামেরা, কালার গ্রেডিং কর্জ করে আনতে পারলেও ভালো গল্প না পেয়ে একসময় নানা গোঁজামিল দিয়ে সিনেমা ছেড়ে দিচ্ছিলেন।
ঢাকাই ফিল্মে অ্যাকশন সিনেমা যারা বেশি বানিয়েছেন, মনতাজুর রহমান আকবর, কাজী হায়াৎ, মালেক আফসারী, মাসুদ পারভেজ অন্যতম। আশি ও নব্বই দশকেই সবচেয়ে বেশি অ্যাকশনধর্মী সিনেমা হয়।
প্রথম অ্যাকশন সিনেমাটি ছিল ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জহিরুল হকের 'রংবাজ'। প্রথম অ্যাকশন হিরো হিসেবে ছিলেন নায়ক রাজ রাজ্জাক। এটির প্রযোজকও ছিলেন রাজ্জাক। ওই বছর ৩০টি মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির মধ্যে এটিই একমাত্র অ্যাকশনধর্মী সিনেমা ছিল। অ্যাকশন সিনেমার পথপ্রদর্শকও এটি। তবে ১৯৮৬ সালের আগে কোনো বছরে একটি-দুটির বেশি অ্যাকশনধর্মী সিনেমা হয়নি। কোনো বছর একটিও হয়নি বা টানা দুই-চার বছরে একটিও হয়নি। ওই বছরই প্রথম ৯টি অ্যাকশনধর্মী সিনেমা হয়। এরপরই এ ধারার দর্শকপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। সিনেমায় নকলের যুগও আসে অ্যাকশন সিনেমার হাত ধরেই। যেমন- শোলে'র কাট টু কাট নকল 'দোস্ত দুশমন'। নকলবাজরা কখনোই বেশিদিন টিকে না। ফলে গত দশক থেকেই অ্যাকশনধর্মী সিনেমাও কমে আসছিল। এ সময় শুধু রোমান্স, সামাজিক ও মারপিটধর্মী সিনেমা হচ্ছিল।
২০১৭ সালে 'ঢাকা অ্যাটাক' দিয়ে শুরু হলো আন্তর্জাতিক রুচির অ্যাকশন সিনেমা। এরপরই নির্মিত হতে থাকে- পাসওয়ার্ড, বীর, শাহেন শাহ, নবাব এলএলবি, মিশন এক্সট্রিম, অপারেশন সুন্দরবন, রক্ত প্রভৃতি। এখন দেখার অপেক্ষা, দ্বিতীয় প্রজন্মের অ্যাকশন সিনেমা কতদূর যেতে পারে।
এমনিতেই অ্যাকশন সিনেমাপ্রেমীরা দ্রম্নত রুচি বদলায়। ফলে একসময় ফোক-ফ্যান্টাসির 'আলাদিন আলীবাবা-সিন্দাবাদ' ধারার সিনেমা যেমন দর্শককে মাতাতে পেরেছে, পরবর্তীতে সেটা আর পারেনি। একসময় সাপের কাহিনী নিয়ে যেসব সিনেমা হয়েছে, এখন সেই সিনেমা কেউ দেখতেই চায় না। মানুষ ফ্যান্টাসি দেখতে চায়, তবে আজগুবি ফ্যান্টাসি নয়। কিন্তু প্রায় তিন দশক সেই ধারার সিনেমাই হয়েছে বেশি। একপর্যায়ে দর্শক সেগুলো দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছে প্রেক্ষাগৃহের আসনেই। এই ঘুম ভাঙানোর জন্যই এখন নতুন নতুন গল্পে ঢাকাই সিনেমা সাজানো দরকার। সে জন্যই নতুন নতুন গল্পে সাজানো থ্রিলার সিনেমাই দর্শককে দিতে পারে নতুন নতুন বিনোদনের খোরাক।