নির্বাচনী বছরের কারণে এবার বাঙালি সংস্কৃতির নানা ঐতিহ্যবাহী মেলার জৌলুসে অনেকখানি ভাটা পড়েছে। এমনিতেই বাঙালি সংস্কৃতির মেলার সেই জৌলুস আগের মতো নেই। নাগরিক জীবনযাত্রায় যত পরিবর্তন আসছে বাঙালি সংস্কৃতির এই মেলাতেও অনেক পরিবর্তন আসছে। আগে যেমন প্রায় সব মেলাতে যাত্রা, চড়কগাছ, কবিগান, বাউলগান, ঘেঁটুগান, টপ্পা, জারিগান, পীর ফকিরদের গান, বায়োস্কোপ, পুতুলনাচ, নাগরদোলা, সং, সার্কাস, কীর্ত্তন, নৌকা বাইচ, ষাঁড়ের লড়াই প্রভৃতি দেখা যেত এখন তার ঐতিহ্য বলতে গেলে নেই-ই।
অথচ বাঙালির অনাবিল আনন্দ-উচ্ছ্বাসের যে অপরূপ সৌন্দর্য, তার প্রকাশ দেখা যায় শীতকালীন মেলাতেই। এখানে মানুষ ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের বাইরে গিয়ে এক সহজ সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলে। গ্রামবাংলার অনুষ্ঠিত হওয়া মেলা এমন এক হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পরিবেশকে ধারণ করে আছে যা অন্য কোনো মাধ্যমেই এর স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটে না।
বাংলাদেশে প্রথম মেলার প্রচলন কবে কোথায় হয়েছিল তা জানা না গেলেও এটা যে আবহমান এক প্রাচীন ঐতিহ্য এ বিষয়ে কারও সংশয় নেই। তবে অনেকেই মনে করেন, দেশের গ্রাম-বাংলায় নদীতীরে অনুষ্ঠিত হওয়া গ্রামীণ হাট থেকেই আসে মেলার ধারণা। অতীতে রাজা-জমিদারেরা মেলার আয়োজন বা পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ধর্মীয় কোনো উপলক্ষেও মেলা বসত। আর এভাবেই মানুষের ইতিহাসের কালক্রমে এমন দেখা যায় এই মেলাকে ধারাবাহিক করতে মাসে মাসেই ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই হয়ে যায় বাংলার 'বারো মাসের তেরো পার্বণ। বৈশাখ থেকে চৈত্র প্রতি মাসেই মেলা হতে থাকে। কখনো কখনো দেখা যায় মাসে একাধিকবারও মেলা বসছে। শ্যামা, কালী, দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্ণী, মনসা প্রভৃতি পূজা তো আছেই পীর-ফকির বা সাধু-সন্যাসীদের আস্তানাগুলো ঘিরেও মেলার মেলা দেখা যেত এক সময়। ধর্মীয় চেতনার বাইরেও অন্যান্য সামাজিক বা লৌকিক আচারগুলোকে কেন্দ্র করেও মেলার আয়োজন হতো এক সময়। সবই ঘটত খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
বাংলাদেশের এমন কোনো জেলা বা উপজেলা নেই যেখানে মেলার আয়োজন করা হয় না। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) গ্রামীণ মেলার ওপর দেশজুড়ে এক কার্যক্রম পরিচালনা করে ১৯৮৩ সালে। ওই জরিপে দেখা গেছে, ১ হাজার ৫টি মেলা অনুষ্ঠিত হয় সারা বাংলাদেশে। জরিপটি তার পঞ্চাশ-একশ' বছর আগে হলে দেখা যেত সেই মেলার সংখ্যা আরও কয়েক হাজার দেখা যেত। বিসিকের প্রাপ্ত সংখ্যার নব্বইভাগ মেলাই গ্রামীণ।
এখনও যেসব মেলা টিকে আছে সেগুলোর মধ্যে আছে, গোপালগঞ্জের কাওড়াকান্দির মেলা, শরীয়তপুরের সুরেশ্বর মেলা, বাগেরহাটের খানজাহান আলীর মেলা, খুলনায় মোলস্নার হাট মেলা, চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ মন্দিরের মেলা, মাইজভান্ডারির মেলা, পটিয়ার ঠেগড়মুনির মেলা, জব্বারের বলী খেলার মেলা, বরিশালের বিপিনচাঁদ ঠাকুরের মেলা, যশোরের মধুমেলা, তাড়াইলের মাঘী পূর্ণিমার মেলা, ধামরাইয়ের রথের মেলা, রংপুরের সিন্দুরমতি মেলা, মুন্সীগঞ্জের ভাগ্যকুল মেলা, নেত্রকোনার চন্ডীগড় মেলা, পিরোজপুরের খারবাক মেলা, কুষ্টিয়ার মহরম মেলা, পঞ্চগড়ের নিরাশির মেলা, মজমপুরের মেলা, নবাবগঞ্জের ধাইনগার মেলা, বিক্রমপুরের রামপালের মেলা, চরখাই কাটলা মেলা, ছেঁউড়িয়ার লালন মেলা, সাঁইজির দোল পূর্ণিমা, বগুড়ায় মহাস্থানগড়ের মেলা, পোড়াদহের সন্ন্যাস মেলা, নড়াইলের সুলতান মেলা, পাবনার বোঁথরের চড়ক মেলা, হবিগঞ্জের মুডাবন্দ দরবার শরীফের মেলা, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর মেলা, ফাইলা পাগলার মাজারের মেলা, রাঙামাটির পানছড়ি বৌদ্ধ মেলা, দিনাজপুরের নেকমর্দন মেলা, কুমিলস্নার শীতলার পিরাজ রায়গঞ্জের বারুনী মেলা, নরসিংদীর শাহরানীর মেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাতমোড়ার মেলা, কুমিলস্নার চৌদ্দগ্রামের বাতিসার মেলা ইত্যাদি।
বাংলা মাসের চৈত্রের প্রথম সপ্তাহে হওয়া সাঁইজির দোল পূর্ণিমায় দেখা যায় এক মহামিলনের সুর বাজছে সেখানে। এই উৎসবে দেশের এবং বিদেশের লালন ভক্তরা একত্রিত হন। দোল পূর্ণিমা শুধু লালনস্মারক উৎসবই নয়, তিনদিনব্যাপী হওয়া এই দোল উৎসবের তাৎপর্য ছোট এক নিবন্ধে শেষ করা যাবে না। একেবারেই সাদামাটা একটি শব্দ 'দোল' যাতে আবহমান প্রকৃতির সকল সৌন্দর্য ও তার গভীরতার লীলায়িত প্রকাশ ঘটে।
'দোল' উৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাংলা বছর শেষের পূর্ণিমা। জড়িয়ে আছে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে। মহাভারত থেকে জানা যায়, যেখানে শ্রীকৃঞ্চ দোলযাত্রা করছেন দেখা যাবে ঠিক ওই তিথিতেই দোল পূর্ণিমার প্রকাশ ঘটবে। এই তিথি বাংলা সংস্কৃতির আরও অনেক গভীরে প্রোথিত। এছাড়া আছে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্মৃতিও। নদীয়া অঞ্চলে জন্ম নেওয়া যিনি বৈষ্ণব ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। এভাবে দোল উৎসবের সঙ্গে সাঁইজির জন্মদিনও জড়িত। যদিও লালনের সঠিক জন্ম তারিখ সম্পর্কে জানা যায় না। যেখানে একালেই অনেকেরই সঠিক জন্ম তারিখের হদিস নেই সেখানে সেকালের মতো পশ্চাদপদ একটি জনসংস্কৃতিতে কী করে কার সঠিক জন্ম তারিখ খুঁজে পাওয়া যাবে! তবে যাই হোক, বৈষ্ণবপন্থী হিসাবে বাউল সাধকদের মধ্যে ফকির লালন শাহকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুরই পুনরাবির্ভাব ও নবজন্মলব্ধ ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। এভাবে আবহমান বাংলায় যত মেলা উৎসব চলে আসছে সবগুলোতেই কম-বেশি কোনো না কোনো ঐতিহ্য মিশে আছে।
সেই ঐতিহ্যকে ধারণ করেই আবহমান বাংলা এক সময় 'মেলার দেশ' হিসেবে খ্যাত হলেও সেই গ্রামীণ মেলার জৌলুস দিন দিন কমে আসছে। কমছে মেলার সংখ্যাও। আগে গ্রামাঞ্চলে বা বিভিন্ন তীর্থস্থানে আয়োজন কমিটির ব্যবস্থাপনায় যেভাবে মেলার আয়োজন হতো সেই চল এখন প্রায় উঠেই গেছে। মানুষ আবহমান বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রেম ভুলে গিয়ে বৈষয়িক প্রেমে ডুবে গেছে। সরকারিভাবেও এই বৈষয়িকপ্রেম প্রাধান্য পাচ্ছে। তাই সরকারিভাবে গ্রামীণ মেলায় তেমন কোনো পৃষ্ঠপোষকতাও করা হয় না।
তবে সরকারিভাবে এখন যেসব মেলায় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয় সেগুলোর মধ্যে আছে বাণিজ্যমেলা, বিজ্ঞানমেলা, শিল্পমেলা, বইমেলা, কৃষিমেলা প্রভৃতি। আবার বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায়ও মেলা হচ্ছে- মোবাইল মেলা, কম্পিউটার মেলা, আইটি মেলা, আবাসন মেলা প্রভৃতি। এগুলোর সবই শহরাঞ্চলের নতুন সংস্কৃতি। গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অংশ নয়। তবে গ্রামীণ সৌন্দর্যমন্ডিত না হলেও এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, এই মেলার মধ্য দিয়েও মানুষের এক অভূতপূর্ব মিলনমেলার প্রকাশ ঘটে।