এক দশকেও তারকা হতে পারছেন না নতুনরা
প্রকাশ | ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মাতিয়ার রাফায়েল
ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে একটা সময় এমন গেছে যারা ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন পা রেখেছেন, মাত্র আট/দশটি সিনেমা করেছেন তাতেই রীতিমত স্টার হয়ে গেছেন। এরপর তো সুপারস্টারও হয়েছেন অনেকে। কিন্তু গত দুই দশক ধরেই সেই চিত্রটি যেন দেখা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যারা মিডিয়া বা গণমাধ্যমে আছেন, দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন তাদেরও অনেকে অভিনয়ে একযুগ পার করে আসা এই শিল্পীদের অনেককেই চিনেন না। জিজ্ঞেস করেন এ কে? তখন তাদের চিনাতেও অনেক কষ্ট হয়। কারণ, তার তো এমন কোনো সিনেমাতে অভিনয় করা হয়নি যে সিনেমাটিকে নিয়ে দেশের আপামর দর্শক কথা বলে। অথচ এখনকার অনেক অভিনয় শিল্পীই আছেন যাদের সিনেমা ১০০টির ঘরে চলে গেছে। কিন্তু দেশের মানুষ তাকে একেবারেই কম চেনে। তাতেই বোঝা যায়, এখনকার দর্শক ঢাকাই চলচ্চিত্র থেকে কত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আবার দেখা যাচ্ছে অনেকে নতুন নায়িকাদের মোটামুটি চিনলেও নায়কদের একেবারেই কম চিনছেন। ফলে সেই একবার সুপারস্টার তকমা পেয়েছেন শাকিব খান বা 'হঠাৎ বৃষ্টি'খ্যাত ফেরদৌস আহমেদ তাদের ছাড়া নতুনদের কাউকে নিয়েই দর্শক তেমন আলোচনাও করে না যেমন তেমন তাদের নামটিও খুব একটা মনে রাখে না কিংবা মনে রাখতে চায় না।
এর কারণ কি? একটা সময় যারা স্টার/সুপারস্টার হয়েছেন তারা কিন্তু সিনেমার গল্পের কারণেই স্টার/সুপারস্টার হয়েছেন। সিনেমার কারণে নয়। গল্পই একটি সিনেমার মূল প্রাণ। এই কথাটি সব সময়েই বেশ জোরেশোরে চলে আসছে। কিন্তু গল্প ভালো হলেই একটি সিনেমা ব্যবসাসফল হবে এটাও চিরসত্য নয়। ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে বহু সিনেমা হয়েছে- যেগুলোতে ভালো, সুন্দর গল্প ছিল কিন্তু সেটা দেখার জন্য প্রেক্ষাগৃহের আসনগুলো ছিল একেবারেই ফাঁকা।
তাহলে ভালো গল্প থাকলেও একটি সিনেমা কেন এমন হয়? সংশ্লিষ্টরা বলেন, এটা নির্মাতার নির্মাণশৈলীতে ঘাটতি থাকার কারণেও হতে পারে আবার অভিনয় শিল্পীরাও এমন হতে পারেন যারা নিজেদের অভিনয় দিয়ে দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতাই তৈরি করতে পারেননি- তাই দর্শক সেই সিনেমা দেখছে না।
তবে এটাও পুরোপুরি ঠিক নয়। অনেক সময় নির্মাতার নির্মাণশৈলীর গুণ এবং গল্প এই দুটো মিলেও এমন সিনেমা হয়েছে যার রেকর্ড ব্যবসার নজির আছে। ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমা হিসেবে 'পরাণ' ও 'হাওয়া' দুটির কথাই ধরা যাক। এই সিনেমা দুটির কোনোটিতেই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির নামকরা অভিনয়শিল্পী ছিলেন না। তবে এমন নজির খুব কমই আছে। সিনেমা দুটোতেই কোনো অভিনয় শিল্পীই এমন প্রতিষ্ঠিত নন, পোস্টারে যাদের নাম দেখেই দর্শক প্রেক্ষাগৃহে যান। চঞ্চল চৌধুরীর একটা দর্শকব্যাংক থাকলেও সেটা টিভি নাটকের সুবাদেই। সিনেমার সুবাদে নয়। তার আরেকটি সিনেমা 'মনপুরা'ও
ব্যবসা সফল। এক্ষেত্রে চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয়গুণকে সামনে রেখেও দুটো সিনেমাতেই পরিচালকের নির্মাণশৈলীর দক্ষতাকেই এগিয়ে রাখতে হবে। তারপরেও সিনেমার জন্য চঞ্চল চৌধুরী সুপারস্টার হননি। তার সুপারস্টার আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল এবং সেটা ছোট পর্দাতেই।
কিন্তু দেশে এমন বহু সাদামাটা গল্পের সিনেমাও হয়েছে যেগুলো ব্যবসা করেছে মূলত দর্শকের কাছে যাদের একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়ে গেছে- পোস্টারে দেখা সেইসব অভিনয়শিল্পীর নামের কারণেই। যারা স্টার/সুপারস্টার তকমা পেয়ে গেছেন দর্শকের কাছ থেকে।
এক সময় একই সঙ্গে এরকম অনেক নায়ক-নায়িকা বা চরিত্র অভিনয় শিল্পী ছিলেন- যে সিনেমা পরিচালকের পাশাপাশি তাদের নামডাকের কারণেও ব্যবসা করেছে। তাই প্রেক্ষাগৃহগুলোতেও তাদের বড় বড় ছবি দিয়ে বিশাল ব্যানার লাগানো থাকতো। সেই ব্যানারগুলো তো হতো সেইসব অভিনয় শিল্পীদের দর্শক ইমেজের কারণেই। 'বেদের মেয়ে জোস্না'র মতো আকাশচুম্বী রেকর্ড ব্যবসা করতে না পারলেও অন্তত কম-বেশি একটা গড় ব্যবসা করেছে। কিন্তু একেবারে মাঠে মারা গেছে এমন সিনেমা বোধহয় তাদের কোনো সিনেমাতেই হয়নি।
ব্যবসা সফল হিসেবে এই তালিকায় উলেস্নখযোগ্য নায়করাজ রাজ্জাক, ওয়াসিম, জাভেদ, আলমগীর, উজ্জ্বল, বুলবুল আহমেদ, সোহেল রানা, জাফর ইকবাল, মাহমুদ কলি, আনোয়ার হোসেন, গোলাম মুস্তাফা, এটিএম শামসুজ্জামান, খলিল, নারায়ণ চক্রবর্তী, রাজীব, হুমায়ুন ফরীদি, রোজী সামাদ (পরে রোজী আফসারী), সুলতানা জামান, আনোয়ারা, শাবানা, কবরী, সুচন্দা, ববিতা, চম্পা, অলিভিয়া, নূতন, সুচরিতা, অঞ্জনা, রোজিনা, অঞ্জু ঘোষ, শাবনূর, মৌসুমী, রুবেল, মান্না, সালমান শাহ প্রমুখ।
অভিনয় দিয়েই তারা প্রত্যেকে দর্শকের কাছে একটা গ্রহণযোগ্য ইমেজ গড়তে সক্ষম হয়েছেন। ফলে প্রত্যেকেরই একটা দর্শকব্যাংক তৈরি হয়ে গেছে। এটা শুধু বাংলা সিনেমাতেই নয়- হলিউড, বলিউড সবখানেই লক্ষ করা যায়।
বহু দর্শক আছে যারা শুধু নিজের প্রিয় নায়ক বা নায়িকার সিনেমাই দেখতে যায় আর কালেভদ্রে যায় অন্যান্য নায়ক-নায়িকার সিনেমা দেখতে। তবে সেটা তখনই যখন দর্শক শোনে একটি সিনেমা খুব ভালো করেছে। নয়তো গড়পড়তা হলে একজনের দর্শকব্যাংকের দর্শক সে সিনেমা দেখতে আগ্রহী হয় না। এই দর্শকব্যাংক এমনই, একটা দর্শকগোষ্ঠী যদি হন শুধু একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রীর ফ্যান বা ভক্ত আরেকটি দর্শকগোষ্ঠী হন অন্য কোনো অভিনেতা বা অভিনেত্রীর ফ্যান। এটা ঠিক আবাহনী-মোহামেডানের দর্শকের মতো। কিংবা রাজনীতির ভোটব্যাংকের মতো।
ঢাকাই সিনেমায় বর্তমানে একমাত্র শাকিব খানেরই সে রকম দর্শকব্যাংক আছে যারা তার সিনেমা মুক্তি পেলেই প্রেক্ষাগৃহে যান। অন্যের সিনেমা মুক্তিতে তাদের যেন কিছুই আসে যায় না। এ কারণে ঢাকাই সিনেমার অবস্থা এমন হয়েছে, শাকিব ছাড়া অন্য কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীর এমন দর্শকব্যাংক নেই- যার ছবি পোস্টারে দেখেই দর্শক প্রেক্ষাগৃহে যাবে। বরং যেন সেই পোস্টারের নায়ক-নায়িকাকে চিনেই না তারা। তাহলে কেন তারা প্রেক্ষাগৃহে যাবে!
ফলে এমন পরিস্থিতিতে একাই একশ' হয়ে একটি সিনেমার পুরো হাল ধরছেন বর্তমানে সিনেমার পরিচালকই। এখন যে ঢাকাই সিনেমা টিকে আছে সেটা পরিচালকদের মুন্সিয়ানাতেই। নায়ক-নায়িকার পরিচিতির কারণে নয়।