কেমন আছেন লালনকন্যা ফরিদা পারভীন

প্রকাশ | ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

মাতিয়ার রাফায়েল
লালনের গান গেয়ে দেশ-বিদেশে খ্যাতি কুড়ানো যেসব শিল্পী আছেন তাদের সবার অগ্রভাগে অবস্থান করছেন বরেণ্য লালনসঙ্গীত শিল্পী ফরিদা পারভীন। যিনি লালনকন্যা হিসেবেই পরিচিত। তার এই অনন্য কীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ সেই ১৯৮৭ সালে একুশে পদক পেয়েছেন। ১৯৯৩ সালে অর্জন করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। জাপানের ফুকুওয়াকা পুরস্কার লাভ করেন ২০০৮ সালে। এ ছাড়া বহু পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। বিবিসি জরিপে যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গান নির্বাচিত করেছে তার মধ্যেও আছে ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে লালনের গান। 'খাঁচার ভিতর অচীন পাখি' নামের এই গানটি বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ ২০ গানের অন্যতম একটি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। লালনসঙ্গীত ছাড়াও আধুনিক ও দেশাত্মবোধক গানেও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ফরিদা পারভীন। শুরুতে নজরুলসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে যাত্রা করলেও পরে পলস্নীগীতিতে তার কণ্ঠ অসাধারণ দরদি হয়ে ওঠে। সেদিক থেকেও তিনি মূলত পলস্নীগীতি শিল্পীই। আজকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে লালন সঙ্গীতসহ সব ধরনের মহাজনী গানের যে জনপ্রিয়তা বাড়ছে, টিভি লাইভ শো থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি স্টেজ শোতে দর্শক-শ্রোতাদের আসন থেকে ফোক গান গাওয়ার জন্য যে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক সিনেমার পেস্ন-ব্যাকেও যেভাবে ফোক গান গুরুত্ব পাচ্ছে- তারই একজন অগ্রগণ শিল্পী হিসেবে ফরিদা পারভীন এদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন। কারণ লালনের গান যখন মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তখন এই লালনের গানের জনপ্রিয়তার কারণেই অন্যান্য মহাজনদের কারা কী গান লিখেছেন সেটা নিয়েও মানুষের আগ্রহ বেড়ে যায়। এখন দেখা যাচ্ছে বাংলায় শুধু এক লালনই নয়, আরও অসংখ্য মহাজন আছেন যাদের গানও আজ বিশ্ব দরবারে আগ্রহের সৃষ্টি করছে। সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে ৫৩ বছরের ক্যারিয়ার পার করছেন ফরিদা পারভীন। লালনসঙ্গীতে কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতি পেয়েছেন তিনি। দেশের এমন কোনো মানুষ নেই যারা লালনসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে ফরিদা পারভীনের নাম শোনেনি। দেশ-বিদেশে ঘুরেছেন লালনের গান নিয়ে তিনি। এখনো সময় ও সুযোগ পেলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা বাঙালি শ্রোতাদের লালনের গান শোনাতে যান। আজকে সারা বিশ্বে লালন সম্পর্কে মানুষের এত যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে এজন্য ফরিদা পারভীনের অবদানও আছে বিপুল। অথচ আজকের এই ফরিদা পারভীনই প্রথমে নজরুল সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বেতারের শিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন। এক পর্যায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর লালন সাঁইজির গানের সঙ্গে ফরিদার যোগাযোগ ঘটে। সেই থেকে ভালোবেসে ফেলেন লালন সঙ্গীতকে। তখন থেকেই তার ধ্যান-জ্ঞান লালনের গান। পরে লালন ঘরানার গানেই খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছেছেন তিনি। নিজে যেমন খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছেন অন্যদেরও আগ্রহী করে তুলেছেন লালনের গান গাইতে। শুধু ফোক ঘরানার শিল্পীরাই নয়, আজকে যারা আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যারা গান করেন রক, পপ- তারাও দর্শক-শ্রোতাদের চাহিদা মেটাতে কখনো কখনো তাদের কণ্ঠে তুলে নেন লালনের গান। গানের ওস্তাদ রবীন্দ্রনাথ রায়, মোতালেব বিশ্বাস এবং ওসমান গণি'র কাছে ক্ল্যাসিক্যাল শেখা ফরিদা পারভীন প্রায় ছয়-সাত বছর তানপুরার সঙ্গে ক্ল্যাসিক্যাল চর্চার পর নজরুল সঙ্গীত শিখতে শুরু করেন। তার নজরুল সঙ্গীতের প্রথম গুরু হচ্ছেন কুষ্টিয়ার ওস্তাদ আবদুল কাদের। এরপর তিনি মেহেরপুরে মীর মোজাফফর আলী'র কাছেও নজরুল সঙ্গীত শেখেন। স্বরলিপি দিয়ে নজরুলের গান হারমোনিয়ামে ও কণ্ঠে তোলার কাজটি তিনি ওস্তাদ মীর মোজাফফর আলী'র কাছেই প্রথম শেখেন। তাই অনেকে মনে করেন, ফরিদা পারভীন যেহেতু প্রথমে ক্লাসিক্যাল গানে দীক্ষা নেন এরপর যে নজরুলের গান শেখেন সেই নজরুলের গানও যেহেতু উচ্চমার্গীয় ক্লাসিক সে কারণেই ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে পরে লালনের গান আরও বেশি উচ্চমার্গের লালনীয় হয়ে উঠতে সাহায্য করে। যে কারণে লালনসঙ্গীতে ফরিদা পারভীনের তুলনা শুধু একজন ফরিদা পারভীনই। ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে যেসব গান শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে 'এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা-সুরমা নদীর তটে', 'তোমরা ভুলেই গেছ মলিস্নকাদির নাম', 'নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে প্রেমের কী সাধ আছে বল', 'খাঁচার ভিতর অচীন পাখি', 'বাড়ির কাছে আরশি নগর' ছাড়াও আরও বহু গান। লালনের গান গেয়ে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া ফরিদা পারভীনের ইচ্ছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এ গানকে আরও বেশি ছড়িয়ে দেওয়ার। এ লক্ষ্যেই তার ফরিদা পারভীন ফাউন্ডেশন হয়েছে। এটার পরিচালনায় 'অচীন পাখি' আছে। ফরিদা পারভীন বলেন, 'এখন তো সবকিছুই কী-বোর্ড নির্ভর। এটা লালন বা লোকগানের উপযোগী নয়। বাঁশির একটা সম্মোহনী শক্তি আছে। বাঁশির অনুভূতি তো কী-বোর্ডে হবে না। একতারা, দোতারা, মন্দিরা, সেঁতার, তবলায় যে মাটির একটা আবেশ আছে, সেটা কী-বোর্ডে পাওয়া যাবে না। লালনের শুদ্ধতার ধারাবাহিকতা রক্ষার্থেই আমরা শিশুদের কণ্ঠশৈলীর পাশাপাশি বৈদু্যতিক যন্ত্রমুক্ত দেশীয় যন্ত্রের ব্যবহার শেখাই।' কিন্তু তারপরও তিনি মনে করেন এটা একা ব্যক্তিগতভাবেও সম্ভব নয়। এজন্য দেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে ফরিদা পারভীন বলেন, 'দেখেন, লালন এ দেশের মাটি ও মানুষেরই এবং আদি ও অকৃত্রিম। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লালন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। অথচ দেখেন আমাদের বেসরকারি চ্যানেলগুলো লালনকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। কিন্তু তারা রবীন্দ্রনাথের জন্য জীবন দিয়ে দেয়। আরও অমুকতমুকের ক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর লালনকে দেখায় সাব-স্টান্ডার্ড পর্যায়ের গান হিসেবে। এগুলো কিন্তু বিতর্কিত। ফোনে এসব বলতে চাই না। আমার কষ্টের জায়গাটি এখানেই। তারা ভুলে যান- আমাদের বাপ-দাদারা লুঙ্গি-গামছা-গেঞ্জি-ফতুয়াতেই নিজেদের পরিচয় খুঁজে পেয়েছেন। এখন তারা শুট-টাইয়ে যতই আত্মগরিমা তুলে ধরুক- কাক কাকই থাকে। ময়ূরপুচ্ছ পরলেই ময়ূর হতে পারে না।' এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে লালনসঙ্গীত শিল্পীরা কিছু ভাবছে কিনা- এমন বিষয়ে জানতে চাইলে ফরিদা পারভীন বলেন- 'সেটা তো তারা একটা জাতি হিসেবে নিজেদের গরজেই করবে। নিজেদের আত্মপরিচয়ের গরজেই করবে। লালনকে তো কেউ বাইরে থেকে ধার করে আনেনি। লালন এ দেশেরই নিজস্ব সম্পদ। তার বাণী সর্বত্রই এখন মেডিটেশন। আন্তর্জাতিকভাবে সব ভাবজগতের শিরোমণি তিনি। আমি তাকে অন্তরে ধারণ করি বলেই সবাইকে বলতে পারি, তারা যেন লালনের সঠিক মূল্যায়ন করেন। ভালো প্রোগ্রাম করেন। যেখানে তারা এটা নিজ উদ্যোগে করবে, সেখানে আমাকে আর কত বলে-কয়ে সেটা করাতে হবে?'