'বাংলা কেবল আবেগের নাম নয়'
এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার'
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী খায়রুন নাহার মিম একুশে ফেব্রম্নয়ারি নিয়ে তার ভাবনা ও প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, বাংলা ভাষা কেবল আমাদের মাতৃভাষা নয়, এটি আমাদের জাতীয় চেতনা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মূলভিত্তি। বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা হিসেবে বাংলার পরিচয় কেবল এর ব্যবহারকারীর সংখ্যার ওপর নির্ভর করে না বরং এর সাহিত্যের ঐশ্বর্য, সঙ্গীত বিপস্নবী চেতনার মাধ্যমে বাংলার পরিচিতি বহুমাত্রিকভাবে বিস্তৃত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কেবল রাজনৈতিক মুক্তিরই সূচনা করেনি, এটি একটি জাতির আত্মপরিচয় সংরক্ষণের লড়াই ছিল।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো মাতৃভাষায় শিক্ষা ও প্রযুক্তির বিকাশে গুরুত্ব দিচ্ছে, কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, মাতৃভাষায় শিক্ষা শিশুদের সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ত্বরান্বিত করে। আমাদেরও বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিল্পের চর্চা বাড়াতে হবে- যাতে জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় আমরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। তবে, দুঃখজনকভাবে বাংলা ভাষায় বিদেশি ভাষার অপ্রয়োজনীয় মিশ্রণ ও ভুল উচ্চারণের প্রবণতা বাড়ছে- যা ভাষার বিশুদ্ধতা নষ্ট করছে। আমাদের উচিত সচেতনভাবে বাংলার সঠিক ব্যবহার চর্চা করা। আজকের প্রজন্মের জন্য আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত বাংলা ভাষাকে আধুনিক বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বাহনে পরিণত করা। বাংলা কেবল আবেগের ভাষা নয়; এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার- যা দিয়ে আমরা বিশ্বমঞ্চে আমাদের পরিচয়কে গৌরবান্বিত করতে পারি। বাংলা ভাষা সম্পর্কে বিশ্বকে জানান দেয়া, বাংলা ভাষার মর্যাদায় বিশ্বকে আলোড়িত করা- এই হোক মহান একুশের নতুন চেতনা।
'একুশ সব সংগ্রামে শক্তি ও সাহসের জোগানদাতা'
অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী এস এম দাহির মাহমুদ বলেন, বাংলা ভাষা শুধু একটি ভাষা নয়, এটি আমাদের জাতীয় চেতনার প্রতীক ও শক্তির উৎস। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল পাকিস্তানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ- যা স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে তোলে। এরপর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার গণ-অভু্যত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকারের পতন। এ আন্দোলনে হাজারো প্রাণ ঝরা সত্ত্বেও আমরা পিছপা হইনি। রূখে দাঁড়িয়েছি, সূচনা হয়েছে আরও এক নতুন বাংলাদেশের। সবকিছুই আমাদের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চেতনা থেকেই অর্জিত।
ভাষা আন্দোলন আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শিখিয়েছে, ভাষা শহীদরা আমাদের বিপস্নবী হতে শিখিয়েছেন। সুতরাং, পূর্ব পাকিস্তান ও পরবর্তী বাংলাদেশ নামক এই ভূ-খন্ডের মানুষ যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে জানে, সেই জানান বিশ্ববাসী ১৯৫২ থেকেই দেখে এসেছে। পৃথিবী জানে আমরা এক বীর জাতি, আমরা সংগ্রামী। ভাষা আন্দোলন থেকে আমরা শক্তি পাই, সাহস পাই। তাই বাংলা ভাষা আমাদের শক্তি, ২১ ফেব্রম্নয়ারি আমাদের শক্তি।
'একুশ আমাদের চেতনায় জাগ্রত এক অগ্নিশিখা'
ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফারজানা জারিন বলেন, একটি জাতির জন্য তার মাতৃভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি তার পরিচয়, তার সংস্কৃতি, তার অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। ইতিহাসে একমাত্র বাংলাদেশই সেই জাতি, যারা নিজেদের মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, আর তারই স্বীকৃতিস্বরূপ আজ ২১ ফেব্রম্নয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
ইউনেস্কো স্বীকৃত এই ভাষা পৃথিবীর অন্যতম মধুর ভাষা, যার প্রতিটি শব্দে মায়ের স্নেহ লুকিয়ে আছে। তাইতো একুশ আমাদের গর্ব, একুশ আমাদের চেতনায় জাগ্রত এক অগ্নিশিখা।
আজকের প্রজন্মের দায়িত্ব একুশের চেতনাকে শুধু ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সীমাবদ্ধ না রাখা, বরং প্রতিটি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। '২৪-এর পুনরুত্থান আমাদের শিখিয়েছে কাকে বন্ধু ভাবতে হবে, কাকে শত্রম্ন হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। পাকিস্তান যেমন আমাদের শত্রম্ন, তেমনই ভারতও আমাদের প্রকৃত বন্ধু নয়। আমরা জানি, আমাদের ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা হয়েছে বারবার, কিন্তু সত্য কখনো মুছে যায় না। একুশ আমাদের শিক্ষা দেয় শত্রম্ন চিনতে, আত্মমর্যাদার সঙ্গে দাঁড়াতে।
'একুশে ফেব্রম্নয়ারি : স্মৃতি, আবেগ ও চেতনার প্রতিচ্ছবি'
প্রথম বর্ষের টেক্সটাইল মেশিনারি ডিজাইন অ্যান্ড মেইনটিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির হোসেন বলেন, শৈশব থেকেই প্রতি নতুন বছরে বাংলা বই খুলে ভাষা আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে লেখা খুঁজতাম। শহীদ দিবসের প্রতি আবেগ তখন ছিল এক গভীর অনুভূতি- যা ধীরে ধীরে চেতনার এক সাহসী প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছে। ছোটবেলায় খালি পায়ে শহীদ মিনারে যাওয়া, সকালে শহীদদের স্মরণে ফুল দেওয়া, বিকালে পাঞ্জাবি পরে বইমেলায় ঘোরা- এসব স্মৃতি আজও হৃদয়ে অমলিন।
আমার বয়স মাত্র ২১, ৫২-৭১ আমি দেখিনি, কিন্তু বইয়ের পাতায় পড়েছি, লোকমুখে শুনেছি, অনুভব করেছি এবং ধারণ করেছি হৃদয়ে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভাষার জন্য সেই দুর্বার চেতনা বহন করে চলেছে। কবি শামসুর রাহমানের 'আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে' কবিতার মতোই শহীদদের রক্ত আমাদের হৃদয়ে এক অবিচ্ছেদ্য শক্তি হয়ে আছে।
'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি' এই স্স্নোগান আমাদের হৃদয়ে ভক্তি ও প্রেরণা জাগায়। তবে, ভাষার প্রতি সম্মান রাখতে আমাদের বাংলা ও বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণ পরিহার করা জরুরি। বাংলা ভাষায় স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, তবেই আমাদের ঐতিহ্য ও ইতিহাস আরও গভীরভাবে হৃদয়ে স্থান পাবে।