মির্জা জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর ছিলেন মধ্য এশিয়ার একজন বিখ্যাত মুসলিম সম্রাট এবং মুঘল সাম্রাজের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি সাধারণত বাবর নামেই অধিক পরিচিত। ১৪৮৩ সালের ১৪ ফেব্রম্নয়ারি তিনি উজবেকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তৈমুর লঙ্গের ষষ্ঠ বংশধর ছিলেন। তৈমুরীয় আমির মীরন শাহের মাধ্যমে বাবরের বংশধারা প্রবাহিত হয়েছে এবং মাতার দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। তিনি মির্জা ওমর সাঈদ বেগের (ওমর সেখ মির্জা) পুত্র ও তৈমুরী শাসক সুলতান মোহাম্মদের প্রপৌত্র ছিলেন। তিনি পানিপথের প্রথম যুদ্ধে দিলিস্নর লোদি রাজবংশের শেষ সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে দিলিস্ন দখল করে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। পানিপথের যুদ্ধে তিনিই প্রথম কামানের ব্যবহার করেন এবং তার প্রখর রণকৌশলের কাছে হার মানেন ইব্রাহিম লোদি।
জহির উদ্দিন মোহাম্মদ তার ডাকনাম বাবর নামেই পরিচিত ছিলেন। বাবর নামটি লোমশ জন্তু বিভার তথা উদবিড়ালের নামের ইন্দো-ইউরোপীয় সংস্করণ।
১৪৯৪ সালে মাত্র বারো বছর বয়সে বাবর প্রথম ক্ষমতা লাভ করেন। তিনি ফরগানার সিংহাসনে আরোহণ করেন, যা বর্তমানে উজবেকিস্তান নামে পরিচিত। তার চাচা অনবরত তাকে সিংহাসনচু্যত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং তার অন্য শত্রম্নও ছিল। এক সময় সে বাবরকে ক্ষমতাচু্যত করতে সফল হয়। ফলে জীবনের বেশকিছু সময় তাকে আশ্রয়হীন এবং যাযাবরের ন্যায় জীবনযাপন করতে হয়। ১৪৯৭ সালে বাবর সমরকন্দের উজবেক শহরে আক্রমণ চালান এবং ৭ মাস পরে শহর দখল করতে সক্ষম হন।
ইতিমধ্যে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরের ফরগানায় কিছু নোবেলদের বিদ্রোহের কারণে তাকে স্থানটি হারাতে হয়। ফরগানা পুনরুদ্ধারের জন্য অগ্রসর হলে তার বাহিনীর লোকজন তাকে ফেলে চলে যায়। ফলে তাকে সমরকন্দ ও ফরগানা উভয়ই হারাতে হয়।
১৫০১ সালে বাবর আবার সমরকন্দ দখল করতে প্রস্তুতি নেন। তবে আবারো তার পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষ মোহাম্মদ শেবানী খানের কাছে পরাজিত হন।
১৫০৪ সালে তুষারসমৃদ্ধ অঞ্চল হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করেন এবং কাবুল দখল করেন। এর ফলে তিনি একটি নতুন ধনী রাজ্য লাভ করেন এবং নিজের ভাগ্য প্রতিষ্ঠা করেন ও বাদশাহ উপাধি গ্রহণ করেন। ১৫০৬ সালে হুসাইন বায়কারাহের মৃতু্য তার অভিযানকে বিলম্বিত করে। বাবর তার মিত্রপক্ষের শহর হেরাতে দু'মাসের জন্য অবস্থান করে সম্পদের অভাবে এলাকা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এর মধ্যেও তিনি এই রাজ্যকে প্রাচুর্য্যমন্ডিত করেছেন। হেরাতের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের আধিক্য তাকে চমৎকৃত করে। তিনি অহিগুরের কবি মীর আলি শির নাভাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হন। নাভাই তার সাহিত্যে চাঘাতাই ভাষার ব্যবহার করতেন, তিনি বাবরকে তার আত্মজীবনী লিখতে উৎসাহিত করেন।
একটি বিদ্রোহ তাকে হেরাত থেকে কাবুল আসতে বাধ্য করে। তিনি এই পরিস্থিতি সামলে উঠেন। তবে দুই বছর পর একটি বিপস্নব সংঘটিত হবার পর তার কিছু শীর্ষস্থানীয় নেতা তাকে কাবুল থেকে তাড়িয়ে দেন। বাবর কিছু সঙ্গীসহ শহর থেকে পালিয়ে গেলেও পুনরায় শহরে ফিরে এসে কাবুল দখল করেন। বিদ্রোহীদের তিনি তার অধীনে নিয়ে আসেন। এদিকে ১৫১০ সালে মোহাম্মদ শেবানী পার্সিয়ার শাসনকর্তা ইসমাঈল সাকাভিদের কাছে নিহত হন। বাবুর এই সুযোগে তার পূর্বপুরুষের রাজ্য তিমুরিদ পুনঃরুদ্ধার করতে চেষ্টা করেন। কয়েক বছর বাবর ইসমাঈলের সঙ্গে মধ্য এশিয়া দখলের জন্য মিলিত হন। বাবর সাকাভিদকে তার রাজ্যে সার্বভৌম রাজা হিসেবে চলার অনুমতি দেন। ইসমাঈল বাবরকে অনেক ধনসম্পদ এবং রসদ সরবরাহ করেছিলেন। এর প্রতিদানে বাবর তাকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছিলেন।
ভারত অভিযান :উত্তর ভারত জয়
বাবরের পশ্চিম দিক থেকে উজবেকদের আক্রমণের ভয় ছিল। ফলে তাকে ভারত ও এর পূর্ব দিকে মনোনিবেশ করতে হয়, বিশেষ করে আইয়ুদিয়ার রাজ্য এবং পেনিনসুলার মালায়া। বাবর নিজেকে সৈয়দ বংশের সত্যিকারের শাসনকর্তা হিসেবে দাবি করেন। একইভাবে তিনি নিজেকে তিমুরের মুকুটের দাবিদার হিসেবে উলেস্নখ করেন। তিমুর প্রকৃতপক্ষে খিজর খানের ছিল। তিনি এটিকে মিত্ররাজ্য পাঞ্জার হাতে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। পরে তিনি দিলস্নী সালতানাতের সুলতান হয়েছেন। সৈয়দ বংশ পরে আফগানের শাসনকর্তা ইবরাহিম লোদির কাছে বেদখল হয়ে যায়।
বাবর এটিকে পুনরুদ্ধার করতে পাঞ্জাব আক্রমণ করার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে কান্দাহার বন্ধ করে দেন। তিনি কাবুলের পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ চালানোর একটি রণকৌশল ঠিক করেন ভারত দখলের জন্য। কান্দাহার বন্ধ করে দেওয়ার ফলে আক্রমণ ধারণাকৃত সময়ের অনেক পরে সংঘটিত হয়। প্রায় তিন বছর পর কান্দাহার ও এর পৌরদুর্গ বেদখল হয়েছিল এবং এছাড়াও অন্যান্য ছোটোখাটো যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই খন্ডযুদ্ধগুলো বাবরকে সফল হবার সুযোগ করে দেয়।
পাঞ্জাবে প্রবেশের সময় বাবরের রাজদূত লঙ্গর খান নিয়াজী বাবরকে পরামর্শ দেন জানজুয়ার রাজপুত্রকে এই অভিযানে সম্পৃক্ত করার জন্য, তাদের এই দিলিস্ন জয়ের অভিযান বেশ পরিচিত লাভ করে। বাবর তার প্রধান ব্যক্তি মালিক আসাদ এবং রাজা সংঘর খানের কাছে তার রাজ্যে ঐতিহ্যগত শাসনের সুফল এবং তার পূর্বপুরুষের সহযোগিতার কথা উলেস্নখ করেন। বাবর শত্রম্নদের পরাজিত করে তাদের নিজের দলে অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৫২১ সালে গাখারসে তার মিত্রদের একত্রিত করেন। বাবর তাদের প্রতিপক্ষ সেনাপ্রধান হসান রানা সাঙ্গাকে পরাজিত করেন, এটিও তার ভারত দখলের অন্তর্ভুক্ত।
বাবর দিলস্নী এবং আগ্রা উভয়ের দখল নেন। ঐদিনই বাবর হুমায়ূনকে আগ্রা যাবার আদেশ দেন জাতীয় ধনসম্পদ লুটপাটের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। হুমায়ূন সেখানে রাজা গোয়ালিয়রের পরিবারকে পান। রাজা যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন এবং তার পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তা নিশ্চয়তা লাভের আশায় হুমায়ূনকে একটি বড় হীরা দেন। এই হীরাটিকে বলা হতো 'কোহিনূর' বা 'আলোর পর্বত'।
বাবর বিজয়ের তৃতীয় দিন দিলস্নী পৌঁছেন।
দিলস্নী ও আগ্রা দখলের পরও বাবর মেওয়ারের রাজপুত রাজ রানা সাঙ্গার দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটাতে লাগলেন। বাবরের অভিযানের আগে রাজপুতের জমিদারেরা সালতানাতের কিছু জাতি জয় করতে সমর্থ হয়েছিল। তারা বাবরের নতুন রাজ্যের দক্ষিণ পশ্চিমের একটি অঞ্চল সরাসরি শাসন করত, যা রাজপুতনা নামে পরিচিত ছিল। এটি কোনো একতাবদ্ধ রাজ্য ছিল না, বরং এটি ছিল রানা সাঙ্গার অধীন কিছু রাজ্যের সংগঠন।
বাবর ১৫৩০ সালের ২৬ ডিসেম্বর আগ্রায় মৃতু্যবরণ করেন। কথিত আছে যে, পুত্রের আরোগ্যের জন্য বাবর নিজেকে উৎসর্গ করেন। পুত্র হুমায়ুন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে পিতা বাবর তার নিজের জীবনের বিনিময়ে স্র্রষ্টার নিকট পুত্রের আরোগ্য কামনা করেন। ক্রমান্বয়ে হুমায়ুন আরোগ্য লাভ করতে থাকেন এবং বাবর পীড়িত হয়ে মৃতু্যবরণ করেন। তার মৃতু্যর পর তার পুত্র মির্জা হুমায়ুন সিংহাসনে আরোহণ করেন।