মানব বসতি
অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সংক্ষেপে জেনে রাখি
বসতি স্থাপনের নিয়ামক : বসতি স্থাপনের পেছনে নানাবিধ প্রাকৃতিক ও সামাজিক কারণ কাজ করে। যেমন : ১. ভূপ্রকৃতি, ২. পানীয় জলের সহজলভ্যতা, ৩. মাটি, ৪. প্রতিরক্ষা, ৫. পশুচারণ, ৬. যোগাযোগ ইত্যাদি।
গ্রামীণ বসতি : গ্রামীণ বসতি অঞ্চলের জনগণ প্রধানত কৃষি পেশায় নিয়োজিত থাকে। গ্রামীণ জনপদের জীবনযাত্রার মান শহরের মানুষের চেয়ে অনুন্নত। গ্রামীণ জনপদের রাস্তাগুলো সোজা না হয়ে আঁকা-বাঁকা ও অনুন্নত হয়। জনপদগুলো বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত ও গোষ্ঠীবদ্ধ হতে পারে। গ্রামীণ জনপদের মানুষ সহজ, সরল ও আন্তরিক হয়ে থাকে।
নগর বসতি : যে বসতি অঞ্চলের জনগণ কৃষিপেশায় নিয়োজিত না থেকে অকৃষিকার্য যেমন : ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহণ, অধিবাসীদের উৎপাদিত দ্রব্যাদির শিল্পজাতকরণ, শিল্প ও শ্রমভিত্তিক ও প্রশাসনিক পেশায় নিয়োজিত থাকে, তাকে নগর বসতি বলে। নগরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, নার্সিংহোম, আমোদ-প্রমোদের জন্য বহুপ্রকার সংস্থা, পার্ক ইত্যাদি থাকে।
গোষ্ঠীবদ্ধ বা সংঘবদ্ধ বসতি : কোনো নির্দিষ্ট স্থানে একত্রে বেশ কয়েকটি পরিবার বহু বাড়িঘর নিয়ে যে বসতি গড়ে তোলে তাকে গোষ্ঠীবদ্ধ বসতি বলে।
বিক্ষিপ্ত বসতি : এ ধরনের বসতিতে একটি পরিবার অন্যান্য পরিবার থেকে ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় বসবাস করে। পৃথিবীর অধিকাংশ বিক্ষিপ্ত বসতি বন্ধুর ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চলে গড়ে উঠেছে।
রৈখিক বসতি : নদী তীরবর্তী উঁচু স্থান, খালের কিনারা এবং রাস্তার পাশে যে বসতিগুলো গড়ে ওঠে তাকে রৈখিক বসতি বলে। এই ধরনের বসতিতে বাড়িগুলো একই সরলরেখায় গড়ে ওঠে।
নগরায়ণ ও নগরসভ্যতা : অনেকের মতে নগরায়ণ বিকাশের ধারাক্রম হচ্ছে- সংগ্রহ ও শিকার, কৃষি এবং নগরায়ণ। নগরের উৎপত্তি লগ্নে অর্থনৈতিক কারণগুলোই প্রাধান্য পায়। নীলনদের অববাহিকায় মেমফিস, থেবস, সিন্ধু অববাহিকায় মহেঞ্জদাড়ো, হরাপ্পা প্রভৃতিতে নগরের উৎপত্তি ঘটে। এগুলো নগর সভ্যতার সূতিকাগার।
নগরের শ্রেণিবিভাগ : বিভিন্ন শহর ও নগরের মধ্যে সাদৃশ্যের চেয়ে বৈসাদৃশ্যই বেশি চোখে পড়ে। এর মধ্যে আয়তন, গঠন, জনসমষ্টির বৈশিষ্ট্য, ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদিতে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ক্রিয়াকলাপের প্রকৃতি ভেদে নগর বসতিগুলোকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়, যথা : ১. সামরিক ক্রিয়াকলাপ ভিত্তিক নগর, ২. প্রশাসনিক নগর, ৩. শিল্পভিত্তিক নগর, ৪. বাণিজ্যভিত্তিক নগর, ৫. সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপ ভিত্তিক নগর, ৬. স্বাস্থ্য নিবাস ও বিনোদনের কেন্দ্র ইত্যাদি।
নগরায়ণের প্রভাব : নগরায়ণ ও নগর কাঠামো গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় কিছু প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন : ১. জনসংখ্যার আকার ও ঘনত্ব, ২. বসত-বাড়ির ধরন, ৩. যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা, ৪. পরিবার, ৫. চালচলন, ৬. খাদ্যাভ্যাস ও পোশাক পরিচ্ছদ, ৭. অর্থনীতি, ৮. সেবা সুবিধা, ৯. শিক্ষা ও চিকিৎসা, ১০. বিনোদন ব্যবস্থা, ১১. অপরাধ বৃত্তি, ১২. রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন ইত্যাদি।
অপরিকল্পিত নগরায়ণে সৃষ্ট সমস্যা : বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শহরে বসবাস করে। তুলনামূলকভাবে যদিও শহরবাসীর সংখ্যা বাংলাদেশে কম। কিন্তু বর্তমান সময়ে এ হার দিন দিন বাড়ছেই। অপরিকল্পিত নগরায়ণের সাথে সাথে প্রত্যক্ষ পরিবেশগত সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে কৃষি জমি কমে যাওয়া, খাবার পানি ও উপযুক্ত পয়ঃনিষ্কাশনের সংকট, বর্জ্য অপসারণ সমস্যা, পরিবহন ও যানজট সংকট, বাসস্থানের অভাব ও বস্তির সৃষ্টি, পানি, বায়ু, মাটি ও শব্দ দূষণ, খোলা জায়গা ও বিনোদন ব্যবস্থার অভাব ইত্যাদি।
প্রশ্ন : বাদল ও শুভ দুজনেই শহরে বাস করে। তবে শুভর শহরটি একটি প্রশাসনিক শহর। অন্যদিকে বাদল যে শহরে বাস করে সেটি আগে গ্রাম হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখানে একটি ইপিজেড প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তা এখন শহর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
ক. কোন সভ্যতায় নগরায়ণের প্রসার ঘটে?
খ. মাটি কীভাবে বসতি স্থাপনে সহায়তা করে?
গ. বাদলের শহরটি গড়ে ওঠার পিছনে ইপিজেড-এর ভূমিকা ব্যাখ্যা কর।
ঘ. শুভর শহরটি বাদলের শহর থেকে ভিন্ন প্রকৃতির-যুক্তিসহ বিশ্লেষণ কর।
উত্তর :
ক. নীল নদের অববাহিকায় মেম্ফিস, থেবস (৩০০০ খ্রিষ্টপূর্ব), সিন্ধু অববাহিকায় মহেঞ্জদাড়ো, হরাপ্পা (২৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব) সভ্যতায় নগরায়ণের প্রসার ঘটে।
খ. বসতি গড়ে ওঠার পেছনে মাটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। মাটির উর্বরা শক্তির ওপর নির্ভর করে বসতি স্থাপিত হয়। উর্বর মাটিতে পুঞ্জীভূত জনবসতি গড়ে ওঠে, কিন্তু মাটি অনুর্বর হলে বিক্ষিপ্ত জনবসতি গড়ে ওঠে। মাটির প্রভাবে জার্মানি, পোল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন প্রভৃতি দেশে বিক্ষিপ্ত জনবসতি সৃষ্টি হয়েছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উর্বরা জমিতে পুঞ্জীভূত জনবসতি গড়ে উঠেছে।
গ. বাদল যে শহরে এখন বসবাস করছে সেটি আগে গ্রাম ছিল। ইপিজেড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে এখন স্থানটি শহরে পরিণত হয়েছে। বস্তুত নগর গড়ে উঠার ক্ষেত্রে শিল্পভিত্তিক ক্রিয়াকলাপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইপিজেড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এখানে জনবসতি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ইপিজেডকে কেন্দ্র করে রাস্তাঘাট, দোকানপাট ইত্যাদি নানারকম অবকাঠামো গড়ে ওঠে। দূর-দূরান্তের মানুষ ইপিজেডে কাজ করার ফলে এখানে নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু হয়। গ্রামের বহু কৃষি জমি ইপিজেডের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এখানকার অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ভিন্নরূপ ধারণ করেছে। বহু মানুষের কর্মক্ষেত্র এই ইপিজেডকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়ায় মানুষ কৃষিজমি বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে। ইপিজেডের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে বাদলের গ্রামটি এখন শহরে পরিণত হয়েছে।
ঘ. শুভর শহরটি একটি প্রশাসনিক শহর। অন্যদিকে বাদলের শহরটি ইপিজেডের কল্যাণে গ্রাম থেকে শহরে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে বাদলের শহরটি একটি শিল্পভিত্তিক শহর। শুভর শহরটিতে বিভিন্ন অফিস, আদালত, হাসপাতাল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। প্রশাসনিক শহর হিসেবে শুভর বাস করা শহরে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। এছাড়া সারাবছর ধরেই বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলো নানা ধরনের সাংস্কৃতিক ও লোক ঐতিহ্যের মেলার আয়োজন করে থাকে। শহরবাসীর জন্য নানা রকমের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যদিকে বাদলের শহরের কর্মকান্ড শুভর শহরের থেকে ভিন্নতর। বাদলের শহরটি একটি নতুন জেগে ওঠা শিল্পভিত্তিক শহর। এখানে মানুষের কর্মকান্ড শিল্পভিত্তিক। চিত্তবিনোদনের তেমন ব্যবস্থা নেই। তাই শুভর শহরটি বাদলের শহর থেকে ভিন্ন প্রকৃতির।
হ পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়