শিক্ষাঙ্গনে ইতিবাচক সম্পর্ক ও ক্যাম্পাস ভাবনা
প্রকাশ | ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
লেখক : ড. ইলিয়াছ প্রামাণিক
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা দেশের সমৃদ্ধির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। ছাত্রসমাজ জাতির মেরুদন্ড হিসেবে ভূমিকা পালন করে। কারণ তাদের শিক্ষা ও চিন্তাধারা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র কাঠামো গঠনে অপরিহার্য। একটি উন্নত রাষ্ট্র গঠনের জন্য শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থা অত্যাবশ্যক। আর এই শিক্ষাব্যবস্থার সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদ্যমান ইতিবাচক সম্পর্কের ওপর। এজন্য শিক্ষাঙ্গনে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার, ন্যায়বিচার, সমতা এবং নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশাগুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা জরুরি। ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলার অন্যতম শর্ত হলো- ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, বৈষম্যহীন প্রশাসনিক কাঠামো এবং একটি সুষ্ঠু ও ইতিবাচক একাডেমিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা। শিক্ষার্থীরা একটি আদর্শ ক্যাম্পাসের প্রত্যাশা করে, যেখানে দুর্নীতি, বঞ্চনা, মর্যাদাহানি, পক্ষপাতিত্ব এবং দলীয় প্রভাবের স্থান নেই। সেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য সমান অধিকার এবং সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হবে, যাতে ন্যায়বিচারের আদর্শ পরিবেশে তারা তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে সফলতা অর্জন করতে পারে।
একটি শিক্ষাঙ্গনের প্রেক্ষাপটে সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রধান স্টেকহোল্ডার হিসেবে স্বীকৃত। তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিয়োজিত শিক্ষকরা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদানের উদ্দেশ্যে গঠিত প্রশাসনিক কাঠামোই শিক্ষাব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে পরিচালিত করে। শিক্ষাঙ্গনের মূল্যায়ন বিভিন্ন মাপকাঠির ওপর নির্ভর করে, এর মধ্যে অন্যতম হলো প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থীদের অবস্থান। যেসব প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থীরা উচ্চতর পদে অধিষ্ঠিত, সেই প্রতিষ্ঠানের মানও তত বেশি ওপরে। এজন্য শিক্ষার্থীদের শিক্ষাঙ্গনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যত বেশি উঁচু, সেখানে ভর্তি প্রতিযোগিতাও তত কঠিন হয়ে ওঠে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় বাছাইকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে, যা শিক্ষাব্যবস্থার মান ও প্রতিষ্ঠানের সুনামকে আরও বৃদ্ধি করে। এই চক্রে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কেবল তাদের নিজস্ব উন্নতির জন্যই নয়, বরং জাতির সার্বিক উন্নয়ন ও প্রগতির জন্যও অপরিহার্য।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিভাবক সংকট দেখা দেয়। কারণ একে একে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কার্যত নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে এবং ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ এক প্রকার অচল হয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের সব একাডেমিক কার্যক্রম স্থগিত থাকে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণগুলো নির্জন ও নীরব হয়ে যায়। তবে সরকার সংকট নিরসনে ধীরস্থির ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করে। একটি সুশৃঙ্খল প্রক্রিয়ায় দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ক্রমে উপাচার্য নিয়োগের কাজ শুরু হয়। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে, যা শিক্ষাঙ্গনে নতুন আশার আলো জ্বালিয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত সব উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যই আন্তর্জাতিক মানের ডিগ্রিধারী, যাদের প্রায় সবাই বিশ্বর্ যাংকিংয়ের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন। এই উপাচার্যরা কেবল তাদের একাডেমিক যোগ্যতার জন্যই নয়, বরং তাদের নেতৃত্বগুণ এবং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্যও প্রশংসিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন অভিভাবক পেয়ে পুনরায় কর্মচাঞ্চল্য লাভ করেছে। প্রশাসনিক কার্যক্রমে গতি সঞ্চারিত হচ্ছে এবং শিগগিরই একাডেমিক কার্যক্রমও স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে বলে আশা করা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের পদচারণায় আবারও ক্যাম্পাসগুলো সরব হয়ে উঠবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার আলো পুনরায় প্রজ্বলিত হবে এবং শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবনের ধারাবাহিকতা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে। এই নবনিযুক্ত উপাচার্যদের দক্ষ নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন যুগের দিকে অগ্রসর হবে। শিক্ষা, গবেষণা এবং উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
জুলাই বিপস্নবের ৩৬ দিনের সময়কালে দেশজুড়ে শত শত শিক্ষার্থীর প্রাণহানির পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উলেস্নখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গেছে। এই নির্মম ঘটনার পর ক্যাম্পাসের শান্তিপূর্ণ ও সুন্দর পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করে একটি পরিবারতুল্য ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর জোর দিচ্ছে। শিক্ষার পবিত্রতাকে রক্ষা করে ক্যাম্পাসকে পুনরায় একটি সৌহার্দপূর্ণ শিক্ষাঙ্গনে পরিণত করতে সবাই সচেষ্ট। এমন পরিস্থিতিতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। ক্যাম্পাসে শান্তি ও সংহতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাদের দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে, যাতে শিক্ষার পরিবেশ পুনরুজ্জীবিত হয় এবং শিক্ষাঙ্গনে পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতার বাতাবরণ সৃষ্টি হয়।
প্রথমত, শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে ফিরে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চার পরিবেশ উন্নত করতে পারস্পরিক সম্পর্কগুলোকে ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। দীর্ঘ তিন মাস পর শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরছেন। তাই এই সময়ের একাডেমিক ক্ষতিপূরণে বিভাগকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের এই প্রচেষ্টায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, হলগুলোতে লেখাপড়ার সুন্দর ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। হলে শুধু বৈধ শিক্ষার্থীরাই থাকবে। এ বিষয়ে হল প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে হবে। হলে কোনো ধরনের বৈষম্য দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে হল প্রশাসনকে অবহিত করতে হবে।
তৃতীয়ত, শিক্ষার্থীদের এই বিপস্নবী সরকারের আইনের প্রতি আস্থাশীল হতে হবে। অপরাধী কোনো ব্যক্তিকে ক্যাম্পাসে দেখা গেলে তার ওপর গড়ন ঔঁংঃরপব করা যাবে না, প্রকটরিয়াল বডি/আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জানাতে হবে। কোনো অবস্থাতেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা আইন নিজের হাতে তুলে নিলে সমাজে খারাপ বার্তা যায় এবং সাধারণ জনগণ আশাহত হয়। যারা জাতিকে রাষ্ট্র সংস্কারের স্বপ্ন দেখায়, তাদের আত্মমর্যাদা সম্পন্ন হওয়া আবশ্যক।
চতুর্থত, শিক্ষার্থীদের তাদের ক্যাম্পাসটিকে জ্ঞানচর্চার উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী কিছু পদক্ষেপ। যেমন : ক্যারিয়ার ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা, জ্ঞানচর্চার জন্য কিছু অনলাইন ও অফলাইন গ্রম্নপ তৈরি করা, অ্যালামনাইদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করা এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার আয়োজন করা।
পঞ্চমত, ক্লাসরুমের বাইরে শিক্ষার্থীদের নিজেদের পছন্দমতো বিভিন্ন অতিরিক্ত পাঠক্রমিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। এজন্য খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক বিভিন্ন পস্ন্যাটফর্ম, বিতর্ক পস্ন্যাটফর্মগুলোকে কার্যকর করতে হবে।
ষষ্ঠত, স্বাধীন মতপ্রকাশের পরিবেশ নিশ্চিত করা, পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে পারস্পরিক সুরক্ষা তৈরি করা এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে নিয়ে সব ষড়যন্ত্রকে রুখে দিতে হবে।
আমরা বিশ্বাস করি, বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও ইতিবাচক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার সম্ভব। এই সহযোগিতার ভিত্তিতে আমরা একটি উদ্যমী ও প্রগতিশীল শিক্ষাঙ্গন নির্মাণ করতে পারি, যেখানে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একসঙ্গে দেশের উন্নতির পথে কাজ করবে। অভু্যত্থান পরবর্তী এই নতুন বাংলাদেশে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় কেবল দেশের মধ্যেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করবে। বিশ্ববিদ্যালগুলোকে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তুলে আমরা বৈশ্বিক অঙ্গনে একটি সম্মানজনক পরিচিতি লাভ করতে পারব। এমন এক ভবিষ্যৎ কল্পনা করছি যেখানে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত প্রযুক্তি, গবেষণা এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অনন্য উদাহরণ স্থাপন করবে। শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবে এবং বাংলাদেশের সুনাম বিশ্বমঞ্চে উচ্চকিত হবে।
লেখক : ড. ইলিয়াছ প্রামাণিক
ছাত্র উপদেষ্টা, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর