মানবতার জয়গানই হোক শিক্ষা
প্রকাশ | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
মশিউর রহমান ইংরেজি শিক্ষক আছমত আলী খান ইনস্টিটিউশন বরিশাল।
সুপ্রিয় শিক্ষার্থীবৃন্দ,
তোমরা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় যাও। সেখানের মূল ফটকে কিছু বাণী উলেস্নখ করা থাকে। যেমন-
'জ্ঞানের জন্য এসো, সেবার জন্য বেরিয়ে যাও',
'জ্ঞানই আলো', 'শিক্ষাই শক্তি, শিক্ষাই মুক্তি' ইত্যাদি। এই বাণীগুলো নিশ্চয়ই তোমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। কিন্তু সেগুলোকে তোমরা কতটা কাজে লাগাতে পারছ, এ প্রশ্নটা কি কখনো নিজেকে করেছ?
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হলেও অন্যান্য প্রাণী থেকে একটু ভিন্ন। কারণ মানুষকে জন্মের পরও আবার মানুষ হতে হয়। তা না হলে পিতা-মাতা, গুরুজন, বিজ্ঞজনরা কেনই বা বলেন- 'বেঁচে থাকো বাবা, মানুষের মতো মানুষ হও, অমানুষ হইও না'। জন্মিলেই মানুষ হয় না, মানুষকে আবার মানুষ হতে হয়। এজন্যই মানুষকে দ্বিজ বলা হয়। মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয় একটি মানবদেহ, বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রাকৃতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সে একজন আদর্শ মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে।
শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। শিক্ষা মানুষকে আচরনিক পরিবর্তন করে। একজন শিক্ষিত মানুষ নিজেও আলোকিত হন, সমাজকেও আলোকিত করেন। একজন শিক্ষিত ও মূর্খ ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য আলো এবং অন্ধকারের।
এবার ধরা যাক, একজন অভিভাবক হিসেবে আমরা আমাদের সন্তান ও একজন শিক্ষক হিসেবে আমাদের শিক্ষার্থীদের কতটা শিক্ষিত করতে পেরেছি। সার্টিফিকেট ঠিকই অর্জন করাতে পেরেছি, যেটা প্রতি বছরের পাবলিক পরীক্ষা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাস করা ডিগ্রিধারীদের সংখ্যা বলে দেয়। যদি আমরা নিজেরা নিজেদের প্রশ্ন করি, অগণিত সনদধারী প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাস করে বের হয়, কিন্তু সত্যিকারের মানুষ হয়ে বের হয় ক'জন?
আমাদের সন্তানেরা যদি শিক্ষার সাথে সাথে মানুষ হতে না পারে, তবে রাষ্ট্র সংস্কার কোন কাজেই আসবে না। আমাদের প্রত্যাশা নতুন প্রজন্ম নিজেরা শিক্ষা-দীক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজে সংস্কার আনবে, তবেই তো সত্যিকারের মুক্তি মিলবে। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের কিছু কিছু কর্মকান্ড আমাদের ভাবিয়ে তুলছে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নির্যাতনে তোফাজ্জল নামে এক যুবকের মৃতু্যর ঘটনা সকলের বিবেককে নাড়া দিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের নির্মম নির্যাতনে একজন তরতাজা যুবকের প্রাণ যাবে এটা কোনভাবেই কাম্য নয়। তাছাড়া মাঝে মাঝেই তাদের মধ্যকার ছোটখাটো বিরোধের কারণে অনেক বড় ধরনের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। মানুষের প্রাণ, রাষ্ট্রের সম্পদ সবকিছুই তাদের কাছে তুচ্ছ মনে হয়। এটাতো আসলে শিক্ষিত মানুষের কাজ হতে পারে না। যেখানে জাতির সমস্যায়, সংকটে ছাত্ররা জীবনবাজি রেখে মানবতার হাত বাড়িয়ে দিবে, কান্ডারী হয়ে হাল ধরবে, সেখানে গুটি কয়েক ছাত্রের নির্মমতা ছাত্রদের গৌরবময় অর্জনকে কিছুটা হলেও ম্স্নান করে তোলে। অভিভাবক শিক্ষকসহ সকলকে চিন্তায় ফেলে দেয়।
একজন শিক্ষিত মানুষ কেবল প্রযুক্তিগত বা পেশাগত দক্ষতা অর্জন করলেও নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাবে সমাজে নানাবিধ সমস্যা তৈরি করতে পারে। মানবিকতার বিকাশ শিক্ষাকে অর্থবহ করে তোলে। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে কেবল পেশাগত সফলতা অর্জন করলেই হবে না বরং মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সফল মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে হবে।
হজরত আলী (রা.) বলেন, 'জ্ঞান অর্থ-সম্পদের চেয়ে উত্তম। কেননা জ্ঞান তোমাকে পাহারা দেয়, কিন্তু অর্থকে উল্টো পাহারা দিতে হয়'। অর্থাৎ, বিদ্যা যদি মানুষকে নৈতিকতা না শেখায়, মানবতা না শেখায় তবে তা কোন বিদ্যাই নয়।
মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের মতে 'সদগুনই জ্ঞান'।
লিও টলস্টয়ের মতে 'জীবনের একমাত্র অর্থ হলো মানবতার সেবা'।
কারিকুলামের পরিবর্তন, পরিমার্জন যাই বলি না কেন, কারিকুলামে নৈতিকতাও মানবিকতাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবার এবং শিক্ষাঙ্গনে মানবতার শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। মানবতার শিক্ষা বিবর্জিত হলে নতুন প্রজন্মের নির্মমতায় বলি হবে অনেক অর্জন। আমাদের সন্তানদের কেবল সনদধারী নয়, সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। আমরা যারা শিক্ষক, অভিভাবক সন্তানদের শিক্ষাদানের কাজে আছি, আমাদের মানবিকতার শিক্ষার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে, যা কিছু ভালো তা অর্জন করবে, যা কিছু খারাপ তা বর্জন করবে। তবেই আমাদের সন্তানরা নিজে আলোকিত মানুষ হবে, অন্যকেও আলোকিত করবে।
মানবতার জয়গানই হোক শিক্ষা।
যেমনটা কবি কুসুম কুমারী দাস বলেছিলেন-
'আমার বাড়ি বাজবে বাঁশি, সবার বাড়ির সুর।
আমার বাড়ি সবার বাড়ি, রইবে নাকো দূর'।
তবেই সমাজ থেকে দূর হবে অন্যায়, প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায়, দূর হবে নির্মমতা, প্রতিষ্ঠিত হবে মানবতা।