অধ্যায়-১৬
প্রাকৃতিক গ্যাস
বাংলাদেশের শক্তি সম্পদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস প্রাকৃতিক গ্যাস, এটি মূলত মিথেন, প্রোপেন, বিউটেনসহ অন্যান্য হাইড্রোকার্বন গ্যাসের মিশ্রণ। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মোট ২৯টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে এবং আরও গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের সম্ভাবনা রয়েছে। এর মাঝে কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন চলছে, কয়েকটি স্থগিত রয়েছে এবং কয়েকটিতে এখনো গ্যাস উৎপাদন শুরু হয়নি।
বাংলাদেশে গ্যাস উৎপাদনের সক্রিয় গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে তিতাস, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ, কৈলাসটিলা, রশিদপুর, হরিপুর ইত্যাদি। তিতাস গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলিত গ্যাস আশুগঞ্জ ও ঘোড়াশালে অবস্থিত সার কারখানা ও তাপবিদু্যৎ কেন্দ্র এবং সিদ্ধিরগঞ্জ তাপবিদু্যৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক গ্যাস অত্যন্ত উন্নত মানের এবং এতে জলীয়বাষ্প কিংবা অপদ্রব্য খুব কম, মিথেনের পরিমাণ অনেক বেশি (৯৬ ু ৯৯%)। দেশের মোট বাণিজ্যিক জ্বালানির প্রায় ৭১% প্রাকৃতিক গ্যাস পূরণ করে। পাইপলাইন বা সিলিন্ডারের মাধ্যমে যে গ্যাস রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয় সেগুলো প্রাকৃতিক গ্যাস শোধন করে উৎপাদন করা হয়ে থাকে।
খনিজ তেল
১৯৮৬ সালে সিলেটের হরিপুরে দেশের একমাত্র খনিজ তেলক্ষেত্রটি আবিষ্কৃত হয়। এ তেলক্ষেত্রে তেলের মোট মজুতের প্রায় ৬০% উত্তোলন করা হয়েছে। ১৯৯৪ সালের শুরুতে তেলের উৎপাদন কমে আসার পর উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে সঠিক উপায়ে মূল্যায়ন কার্য পরিচালনার পর আবার পূর্ণমাত্রায় তেল উৎপাদন করা যেতে পারে।
আকরিক ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ এবং চাহিদার তুলনায় এ দেশ খনিজ সম্পদে যথেষ্ট সমৃদ্ধ নয়। এজন্য নানান প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রকার খনিজ সম্পদ প্রতিবছর অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা হয়। খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ না হলেও বেশ কিছু খনিজ পদার্থ এ দেশে পাওয়া যায় যার মধ্যে অন্যতম হলো- চুনাপাথর, সিলিকা বালু, কঠিন শিলা, নুড়ি পাথর ইত্যাদি।
চুনাপাথর
মূলত সিমেন্ট শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে চুনাপাথর ব্যবহার করা হয়। এছাড়া গৃহনির্মাণ কাজে, কাচ শিল্পে, ইস্পাত, সাবান, কাগজ কিংবা রং তৈরিতে চুনাপাথর ব্যবহৃত হয়। দেশের প্রথম চুনাপাথরের খনি ১৯৬০ এর দশকের শুরুতে সুনামগঞ্জের টেকেরঘাটে আবিষ্কৃত হয়। এছাড়া সুনামগঞ্জের লালঘাট ও বাগলিবাজার, সিলেটের জাফলং, জকিগঞ্জ, চরগা, নওগাঁ জেলার জাহানপুর ও পরানগর, জয়পুরহাট জেলার জয়পুরহাট ও জামালগঞ্জে চুনাপাথর পাওয়া যায়।
সিলিকা/ কাচবালি :এটি কাচ উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল। এছাড়া রং ও বিভিন্ন রকমের রাসায়নিক তৈরিতে এর ব্যবহার আছে। বাংলাদেশে কাচবালির মজুত উলেস্নখযোগ্য। কাচবালি হলো সূষ্ম থেকে মাঝারি আকৃতির কোয়ার্টজ এবং সেগুলো হলুদ থেকে ধূসর বর্ণের হয়ে থাকে। ভূপৃষ্ঠের উপরে বা ভূ-পৃষ্ঠের অগভীরে বালিজুরী, শাহজিবাজার ও চৌদ্দগ্রামে এবং ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে মধ্যপাড়ায় ও বড়োপুকুরিয়ায় কাচবালির বড়ো মজুত আবিষ্কৃত হয়েছে।
কঠিন শিলা/পাথর
ঘরবাড়ি, রাস্তা, রেললাইন, নদীর বাঁধ ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণে কঠিন শিলার প্রচুর ব্যবহার হয়। রংপুর জেলার বদরগঞ্জ থানার রানীপুকুর নামক স্থানে ১৯৬৬ সালে প্রথম কঠিন শিলার সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর পরবর্তী সময়ে দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়া নামক স্থানে কঠিন শিলার মজুত আবিষ্কার করে। এছাড়া নওগী জেলার পত্নীতলা, সিলেটের ভোলাগঞ্জ এবং পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় কঠিন শিলা পাওয়া যায়।
চীনামাটি
চীনামাটি মূলত কেয়োলিন নামক কাদা খনিজ দিয়ে গঠিত উন্নতমানের কাদাকে বোঝানো হয়ে থাকে। চীনামাটি মূলত সিরামিক শিল্পে বিভিন্ন তৈজসপত্র, স্যানিটারি জিনিসপত্র, বাসন ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ভূপৃষ্ঠে বা ভূপৃষ্ঠের সামান্য নিচে নেত্রকোণা জেলার বিজয়পুর, শেরপুর জেলার ভুরুংগা ও চট্টগ্রাম জেলার হাইটগাঁও, কাঞ্চপুর, এলাহাবাদ এবং ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়ায় চীনামাটির মজুত আবিষ্কৃত হয়েছে।
নুড়িপাথর
দেশের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত এলাকায় হিমালয়ের পাদদেশ বরাবর নুড়িপাথর পাওয়া যায়। এগুলো বর্ষাকালে উজান এলাকা থেকে নদী দ্বারা বাহিত হয়ে আসে। নুড়িপাথর বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমে ব্যবহার করা হয়।
নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত বালি
বাংলাদেশের উপর দিয়ে অসংখ্য নদনদী প্রবাহিত হয়েছে যা এ দেশকে নদীমাতৃক দেশ বলার অন্যতম কারণ দেশের বিভিন্ন নদনদীর তলদেশে এ ধরনের বালি পাওয়া যায়। মূলত মাঝারি থেকে মোটা দানার কোয়ার্টজের সমন্বয়ে এই বালি গঠিত অন্যান্য মনিক বা মিনারেলও এই বালিতে মিশ্রিত থাকে। দালান, রাস্তাঘাট, বীধ, সেতু এ ধরনের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও উন্নয়নমূলক অবকাঠামো নির্মাণকাজে এই বালির প্রচুর ব্যবহার হয়।
সৈকত বালি ভারী মনিক
বাংলাদেশের উপকূলীয় সৈকত এলাকাগুলোতে এ ধরনের খনিজ পাওয়া যায়। মূলত কক্সবাজার থেকে বদর মোকাম ও মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও মাতারবাড়িতে ভারী মনিকের মজুদ রয়েছে। সূক্ষ্ণ জরিপকাজ পরিচালনার ফলে বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত বরাবর ১৭টি স্থানে ভারী মনিকের মজুত লক্ষ করা যায় যেগুলোকে পেস্নসার মজুত বলা হয়।
এগুলোর মাঝে ১৫টি পেস্নসার মজুত কক্সবাজার চট্টগ্রাম সমুদ্রসেকত ও কাছাকাছি উপকূলীয় দ্বীপসমূহে অবস্থিত। এসব ভারী মনিক ঢালাই, তাপরোধী বস্তু ও কাচ তৈরিতে এবং জিরকোনিয়াম ধাতু নিষ্কাশনে ব্যবহৃত হয়।
হ পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়