অষ্টম শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ

প্রকাশ | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

হাবিবুর রহমান বাপ্পা, সহকারী শিক্ষক, শহীদ বীর-উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজ, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট
চর্তুদশ অধ্যায় গৃহস্থালির রসায়ন রসায়ন তোমার দৈনন্দিন জীবনের একটি বড় অংশ। যেমন ু খাবার, বাতাস, পানি, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, পরিষ্কার করার রাসায়নিক এবং যা কিছু আমরা দেখতে বা স্পর্শ করতে পারি, এমন প্রতিটি বস্তুতে রসায়ন বা রসায়নের ব্যবহার খুঁজে পাওয়া যাবে। আমরা যদি খাবারের কথা বলি তাহলে দেখবে সেখানেও রসায়নের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে এই অধ্যায়ে খাবার লবণ, বেকিং সোডা ও ভিনেগার এই তিনটি খাদ্য সামগ্রীর রসায়ন নিয়ে আলোচনা করা হবে। খাদ্য সামগ্রীর রসায়ন (ঋড়ড়ফ ঈযবসরংঃৎু) আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পাশাপাশি, আমাদের প্রতিটি খাদ্য পণ্যের পিছনে রসায়নের ভূমিকা অভাবনীয়। চলো সেগুলো সম্পর্কে জেনে আসি। ক. খাবার লবণ বা সোডিয়াম ক্লোরাইড (ঘধঈষ) : আমরা জানি, সমুদ্রের পানিতে প্রচুর পরিমাণে খাবার লবণ (ঘধঈষ) থাকে, সঙ্গে খুবই সামান্য পরিমাণে ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইডসহ অন্যান্য কিছু লবণ থাকে। আমাদের দেশে আমরা সমুদ্রের পানি থেকে খাবার লবণ সংগ্রহ করে থাকি। কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সমুদ্র উপকূলের লবণ চাষিরা বিভিন্ন আকৃতির জমির চারপাশে বাঁধ তৈরি করে একপাশ খানিকটা খুলে রাখে। সমুদ্রের জোয়ারের সময় যখন পানি ওই জায়গায় প্রবেশ করে, তখন পানি প্রবেশের মুখ বন্ধ করে জোয়ারের পানি আটকে রাখা হয়। সূর্যের তাপে এ জায়গার পানি বাষ্পীভূত হয়ে গেলে লবণ দেখতে পাওয়া যায়। লবণ চাষের মাধ্যমে পাওয়া লবণকে শিল্প কারখানায় পরিশোধিত করে খাওয়ার উপযোগী লবণে পরিণত করা হয়। সোডিয়াম ক্লোরাইডের (ঘধঈষ) ব্যবহার : সোডিয়াম ক্লোরাইড বা খাদ্য লবণের খাদ্য সংক্রান্ত ব্যবহার ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রেও নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। নিচে লবণের কিছু ব্যবহারের কথা বলা হলো : ১. লবণ দীর্ঘদিন ধরে খাবারের স্বাদ বের করে আনার জন্য ব্যবহার করা হয়। ২. খাবার সংরক্ষণের কাজে লবণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেমন- নোনা ইলিশ। ৩. রান্না করার সময় পানির তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্য লবণ ব্যবহার করা হয়। ৪. ডায়রিয়া হলে মানুষের শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি হয়। এই পানিশূন্যতা দূর করার জন্য খাবার স্যালাইন খাওয়ানো হয়। আর খাবার স্যালাইন বানানোর অন্যতম উপাদান হচ্ছে লবণ। ৫. শীতপ্রধান দেশে রাস্তায় জমে থাকা বরফ গলিয়ে ফেলার জন্য লবণ ছিটিয়ে দেওয়া হয়। ৬. ট্যানারি শিল্পে সংগৃহীত পশুর চামড়া প্রাথমিকভাবে রক্ষা করার জন্য লবণ ব্যবহার করা হয়। ৭. লবণ বিস্নচিং, মৃৎপাত্র, সাবান এবং ক্লোরিন উৎপাদনেও ব্যবহৃত হয়। রাসায়নিক শিল্পে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (ঘধঙঐ) যৌগ প্রস্তুত করার জন্য লবণ ব্যবহার করা হয়। এছাড়া, অন্যান্য শিল্প কারখানায়ও এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। খ. ভিনেগার : ভিনেগার হলো অ্যাসিটিক অ্যাসিডের একটি জলীয় দ্রবণ। ভিনেগারে ৫-১০% অ্যাসিটিক অ্যাসিড থাকে। বিভিন্ন ফলের রস থেকে ভিনেগার তৈরি করা হয়, তাই বাজারে নানা ধরনের ভিনেগার পাওয়া যায়। খাদ্য সামগ্রী, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং গৃহস্থালি কাজে ভিনেগার ব্যবহার করা হয়। ভিনেগারের ব্যবহার : ১. খাদ্য সংরক্ষণে ভিনেগারের ভূমিকা রয়েছে। আচার ঠিক রাখতে ভিনেগার ব্যবহার করা হয়। যদি আচার তৈরিতে ভিনেগার ব্যবহার করা হয়, তাহলে তাতে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে না। ভিনেগারের অ্যাসিটিক অ্যাসিড যখন আচারে দেওয়া হয়, তখন সেখান থেকে ত্যাগকৃত মন ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে দিতে পারে। ফলে খাবার দীর্ঘদিন ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। ২. খাবারের স্বাদ এবং ঘ্রাণ বাড়ানোর কাজে ভিনেগার ব্যবহার করা হয়। ৩. আয়না, কাচ কিংবা টেবিল পরিষ্কার করতে, রান্নাঘর কিংবা বাথরুম দুর্গন্ধমুক্ত করতে এবং গৃহস্থালি কাপড়, কার্পেট কিংবা সোফায় দাগ দূর করতে ভিনেগার ব্যবহার করা হয়। ৪. চুল, ত্বক কিংবা পরিশ্রান্ত পায়ের পাতা সতেজ করতে ভিনেগারের দ্রবণ ব্যবহার করা হয়। ৫. বাগানের আগাছা দূর করার জন্যও ভিনেগার ব্যবহার করা যায়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার রসায়ন আমাদের সুস্থ থাকতে হলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিকল্প নেই। আমাদের শরীর এবং চারপাশের সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলে মনও ভালো থাকে।এই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের পরিষ্কারক ব্যবহার করে থাকি। আমাদের শরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রসাধনী সাবান ব্যবহার করি। কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করার জন্য কাপড় কাচা সাবান বা সোডা ব্যবহার করি। জীবাণুনাশক হিসেবে বিস্নচিং পাউডারের ব্যবহার রয়েছে। এছাড়া ৮০-৯৫% ইথানল বা আইসো প্রোপাইল অ্যালকোহল করোনাভাইরাসের মতো অতি সংক্রামক জীবাণু ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার করা হয়। ঘরের জানালার কাচ বা অন্যান্য কাচদ্রব্য পরিষ্কারের কাজে গস্নাস ক্লিনার ব্যবহার করা হয়। টয়লেট পরিষ্কার করার জন্য টয়লেট ক্লিনার ব্যবহার করা হয়। এগুলো সবই রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয়, অর্থাৎ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য রসায়নের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কয়েকটি সামগ্রী সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো।- ক. কাপড় কাচার সোডা সোডিয়াম কার্বনেট হচ্ছে সোডা অ্যাস। এই সোডা অ্যাসের একটি অণুর সঙ্গে দশ অণু পানি রাসায়নিকভাবে যুক্ত হলে তাকে কাপড় কাচা সোডা বা ওয়াশিং সোডা বলা হয়। সেজন্য কাপড় কাচা সোডার রাসায়নিক নাম হচ্ছে সোডিয়াম কার্বনেট ডেকা হাইড্রেট। কাপড় কাচার সোডা কাপড় থেকে দুর্গন্ধ দূর করতে, দাগ সরাতে এবং পরিষ্কার করতে ব্যবহার করা হয়। খ. টয়লেট ক্লিনারের মূল উপাদান হচ্ছে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড। এর সঙ্গে কিছু পরিমাণ সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট (ঘধঙঈষ) মিশ্রিত থাকে। টয়লেট, বেসিন এবং কমোডে চর্বি ও প্রোটিন জাতীয় পদার্থ, বিভিন্ন রঙ জাতীয় জৈব ও অজৈব পদার্থ এবং বিভিন্ন ধরনের জীবাণু থাকে। বেসিন, কমোড ইত্যাদি পরিষ্কার করার জন্য এই টয়লেট ক্লিনার ব্যবহার করা হয়। টয়লেট ক্লিনার দ্বারা পরিষ্কার করার কৌশল : টয়লেট ক্লিনারে বিদ্যমান সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট (ঘধঙঈষ) পানির সাথে বিক্রিয়া করে সোডিয়াম হাইপোক্লোরাস অ্যাসিড (ঐঙঈষ) এবং সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (ঘধঙঐ) উৎপন্ন করে। হ পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায় সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড ক্ষারধর্মী হওয়ার কারণে চর্বি ও প্রোটিন জাতীয় পদার্থকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, হাইপোক্লোরাস অ্যাসিড (ঐঙঈষ) ভেঙে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড (ঐঈষ) ও জায়মান অক্সিজেন [ঙ] উৎপন্ন করে। (তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে লিখে [ঙ] জায়মান অক্সিজেনকে বোঝানো হয়) কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে রসায়ন কৃষি এবং শিল্প ক্ষেত্রে রসায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উভয় ক্ষেত্রেই রসায়ন নতুন নতুন উদ্ভাবন করে আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য সচেষ্ট রয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের ব্যবহার ফসল উৎপাদনে একটি অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। এই সার ফসলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে এবং তাদের ফলন বহুগুণে বৃদ্ধি করে। সারের পাশাপাশি রাসায়নিক কীটনাশক ফসলকে কীটপতঙ্গ, রোগ এবং আগাছা থেকে রক্ষা করে। রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মাটিকে বিশ্লেষণ করে কোন মাটিতে কোন ফসল ফলানো সম্ভব এবং তার জন্য কোন ধরনের সার কতটুকু প্রয়োগ করতে হবে সে ব্যাপারে কৃষকদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। রসায়নের সহায়তা নিয়ে বিভিন্ন কৃষিজাত ফসল ও ফলমূল সংরক্ষণ করার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় এবং খাবারের রসায়ন দিয়ে কৃষিজাত খাদ্যের পুষ্টিগুণ নির্ণয় করা হয়।