প্রাণিজগতের শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তি
প্রাণিজগৎ একটি সুবিশাল রাজ্য এবং বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে এদেরকে বিভিন্ন পর্বে ভাগ করার চেষ্টা করা হয়। কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীর প্রাণিকূলের বৈশিষ্ট্যসমূহ নানাভাবে বিবর্তিত হয়েছে। সময়ের সঙ্গে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য দেখা দিয়েছে।
আবার ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে বিভিন্নভাবে এই প্রাণীরা নিজেদের অভিযোজিত করেছে। ফলে অসম্ভব বৈচিত্র্যময় যে প্রাণিজগৎ আমরা এখন দেখতে পাই তাদেরকে হাতেগোনা কয়েকটা পর্বে ভাগ করা অত্যন্ত কঠিন। এই কারণে প্রাণিজগতের শ্রেণিবিন্যাস নিয়ে অনেকক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদও আছে।
প্রাণীর শ্রেণিবিন্যাস বিষয়ক বৈশিষ্ট্য
পৃথিবীর এ পর্যন্ত শনাক্তকৃত সকল প্রাণীকে তাদের সুনির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নয়টি বড় পর্বে ভাগ করা হয়েছে। যে সকল বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে প্রাণীর এই শ্রেণিবিন্যাস করা হয় তাকে প্রাণীর শ্রেণিবিন্যাস বিষয়ক বৈশিষ্ট্য (ঞধীড়হড়সরপ পযধৎধপঃবৎরংঃরপং) বলা হয়। প্রথমেই এই বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে একটু জেনে নেয়া যাক।
কয়েকটি প্রধান শ্রেণিবিন্যাস বিষয়ক বৈশিষ্ট্য নিচে ব্যাখ্যা করা হলো :
১. কোষের বিন্যাস :
বিভিন্ন প্রাণীর গঠনের বিন্যাস অনুযায়ী তাদের আলাদা করা যায়। অপেক্ষাকৃত আদিম ও সরল বহুকোষী প্রাণী, যেমন-স্পঞ্জের গঠন পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এদের শারীরবৃত্তীয় কাজ সম্পন্ন হয় কোষীয় পযার্য়ে, অর্থাৎ কোষগুলো অবিন্যস্ত থাকে এবং আলাদা আলাদাভাবে নিজেদের কাজ সম্পন্ন করে। এর চাইতে একটু জটিল প্রাণী, যেমনুজেলিফিশের ক্ষেত্রে কোষগুলো একত্র হয়ে কলা বা টিসু্য হিসেবে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজে অংশ নেয়।
এর চেয়ে জটিলতর প্রাণীর ক্ষেত্রে একাধিক টিসু্য বা কলা মিলে নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করার জন্য অঙ্গ গঠন করে। মানুষ বা অন্যান্য মেরুদন্ডী প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই কলা বা টিসু্যগুলো শুধু যে সুসংবদ্ধ হয়ে অঙ্গ তৈরি করে তাই নয়, একাধিক অঙ্গ আবার একসঙ্গে মিলে এক একটা তন্ত্র গঠন করে, যা আবার সুশৃঙ্খলভাবে নির্দিষ্ট কোনো কাজ সম্পন্ন করে।
২. দেহের প্রতিসাম্য :
দেহের প্রতিসাম্যের ভিত্তিতে প্রাণীদের আলাদা করা যায়। কোনো কোনো প্রাণী একেবারে অপ্রতিসম, যেমন স্পঞ্জ। এদের দেহকে হুবহু একই রকম একাধিক অংশে বিভক্ত করা সম্ভব নয়। আবার তেলাপোকা, পাখি বা মানুষকে লম্বালম্বি হুবহু একইরকম দুভাগে ভাগ করা সম্ভব। এই প্রাণীরা দ্বিপার্শ্বীয় প্রতিসম। আবার তারামাছ, জেলিফিশ ইত্যাদি বেশ কিছু প্রাণী আছে যাদের দেহকে চার, পাঁচ বা আরও বেশি অভিন্ন অংশে বিভক্ত করা সম্ভব। এদের প্রতিসাম্যের ধরন হলো ৎধফরধষ বা অরীয় প্রতিসাম্য।
৩. দেহগহ্বর বা সিনোম
প্রাণিদেহে বিশেষভাগে গঠিত দেহগহ্বর আছে কি নেই, থাকলে এর গঠন কেমন সেটি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এবং এর ওপর ভিত্তি করেও বিভিন্ন প্রাণীর শ্রেণি বিভাগ করা হয়। প্রাণিদেহে এই বিশেষ দেহগহ্বরের ভূমিকা অনেক। এই গহ্বর বা সিলোমে দেহের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অঙ্গ (বিশেষ করে পরিপাকতন্ত্রের অঙ্গসমূহ) একত্র হয়ে আবদ্ধ থাকে।
এর ফলে এই অঙ্গসমূহ যেমন সুসংবদ্ধভাবে কাজ করতে পারে। এই দেহগহ্বরের ভেতরে অঙ্গসমূহ এক ধরনের তরলে নিমজ্জিত থাকে বলে বাইরের চাপ বা ধাক্কা থেকেও সেগুলো সুরক্ষিত থাকে প্রবাল বা ফিতাকৃমির মতো সরল জীবসমূহের শরীরে সুগঠিত দেহগহ্বর দেখা যায় না, অন্যদিকে মানুষসহ অন্য জটিলতর জীবে বা মেরুদন্ডী প্রাণীর দেহে সুগঠিত দেহগহ্বর থাকে।
৪. দেহ খন্ডের উপস্থিতি
কোনো কোনো প্রাণীর দেহ একাধিক খন্ডে বিভক্ত থাকে, যেমন-কীট-পতঙ্গের দেহ তিন খন্ডে বিভক্ত, কিন্তু মাকড়শার দেহ দুই খন্ডে বিভক্ত। অনেক ক্ষেত্রে এরকম একাধিক খন্ডে আবার একই অঙ্গের ধারাবাহিক পুনরাবৃত্তি লক্ষ করা যায়। প্রাণীর শ্রেণিবিভাগের ক্ষেত্রে এটাও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
৫. কঙ্কালতন্ত্রের ধরন
কোনো প্রাণীর কঙ্কালতন্ত্র আছে কি নেই, থাকলে তার ধরন কেমন-শ্রেণিবিন্যাস করার সময় এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয়। কোনো কোনো প্রাণীর দেহের ভেতরে সুগঠিত কঙ্কালতন্ত্র থাকে, যেমন-মানুষসহ সকল মেরুদন্ডী প্রাণী।
আবার কোনো কোনো প্রাণীর দেহের ভেতরে এরকম কঙ্কাল না থাকলেও দেহের বাইরে বহিকঙ্কাল দেখা যায়, যেমন- শামুক বা কাকড়া জাতীয় প্রাণী। আবার কচ্ছপের মতো ব্যতিক্রমী উদাহরণও আছে যার অন্তঃকঙ্কাল, বহিকঙ্কাল দুটিই আছে।
উপরে উলেস্নখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর বাইরে খাদ্য পরিপাকের প্রক্রিয়া, দেহের সংবহন প্রক্রিয়া, প্রজননের ধরন-ইত্যাদিও প্রাণিকূলের শ্রেণিবিন্যাস করতে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হয়।