অষ্টম অধ্যায়
আমাদের চারপাশে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে থাকে, লোহার জিনিসপত্রে মরিচা পড়লে, কোথাও কিছু আগুনে পুড়ে গেলে, কিংবা দেহে আমাদের খাদ্য পরিপাকের সময় আসলে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে। এছাড়াও বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন নতুন পদার্থ তৈরি করে থাকেন।
এইসব নানা ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে কখনো শক্তি উৎপন্ন হয়, কখনো আমাদের ব্যবহারের জিনিসপত্র তৈরি হয় আবার কখনো নতুন কোনো ওষুধ তৈরি করা হয়। রাসায়নিক বিক্রিয়া বোঝার জন্য আমাদের যে বিষয়গুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে এই অধ্যাযয়ে সেই বিষয়গুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হযয়েছে।
প্রতীক, সংকেত, যোজনী
আগের শ্রেণিতে তোমরা জেনেছ যে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর সকল পদার্থকে তাদের গঠন অনুসারে দুই শ্রেণিতে ভাগ করেছেন, আর তা হচ্ছে মৌলিক ও যৌগিক পদার্থ। বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত মোট ১১৮টি মৌলিক পদার্থের (বষবসবহঃং) সন্ধান পেযয়েছেন। সাধারণত এইসব মৌলের পুরো নাম না লিখে ইংরেজি বা ল্যাটিন নামের প্রথম একটি অথবা দুইটি অক্ষর দিযয়ে সংক্ষেপে মৌলটিকে প্রকাশ করানো হয়। মৌলের পুরো নামের এ সংক্ষিপ্ত রূপকে প্রতীক বলা হয়। যেমন- হাইড্রোজেন (ঐুফৎড়মবহ) এর প্রতীক হচ্ছে ঐ, অক্সিজেন (ঙীুমবহ)-এর প্রতীক ঙ, ইত্যাদি।
আবার কোনো মৌল বা যৌগের অণুর সংক্ষিপ্ত রূপকে সংকেত দ্বারা প্রকাশ করা হয়। কোনো অণুর সংকেত থেকে এতে বিদ্যমান পরমাণুগুলোর সংখ্যা বোঝা যায়। যেমন-হাইড্রোজেন অণুর সংকেত ঐ২, অর্থাৎ হাইড্রোজেন অণুতে দুইটি হাইড্রোজেন পরমাণু রযয়েছে, হাইড্রোজেন ক্লোরাইড অণুর সংকেত ঐঈষ অর্থাৎ হাইড্রোজেন ক্লোরাইড অণুতে একটি হাইড্রোজেন পরমাণু এবং একটি ক্লোরিন পরমাণু রযয়েছে, ইত্যাদি।
কোনো যৌগের সংকেত লেখার জন্য সেই যৌগের মৌলগুলোর যোজনী সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। মৌলগুলো একে অন্যের সাথে রাসায়নিকভাবে যুক্ত হয়ে যৌগ গঠন করে এবং যোজনীর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি কীভাবে একটি মৌলের পরমাণু অন্য মৌলের পরমাণুর সাথে যুক্ত হবে।
আরও সহজভাবে বোঝার জন্য আমরা মৌলিক পদার্থের যোজনীকে একেকটি হাতের সাথে তুলনা করতে পারি। যে মৌলের যতগুলো হাত তার যোজনী হবে তত। যেমন- হাইড্রোজেন এবং ক্লোরিন উভযয়ের যোজনী এক, তাই উভয়কে আমরা একহাতবিশিষ্ট মৌল হিসেবে কল্পনা করতে পারি।
অর্থাৎ একটি হাইড্রোজেন পরমাণু তার একটি হাত দিয়ে ক্লোরিন পরমাণুর একটি হাতকে ধরে রাখবে। তাই হাইড্রোজেন ও ক্লোরিন দিযয়ে গঠিত হাইড্রোজেন ক্লোরাইডের সংকেত হচ্ছে ঐঈষ. অক্সিজেনের যোজনী দুই, কাজেই আমরা কল্পনা করতে পারি অক্সিজেনের একটি পরমাণুর দুইটি হাত রয়েছে যার মাধ্যমে অক্সিজেন একযোজী বা এক হাতবিশিষ্ট দুইটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সাথে যুক্ত হতে পারে।
রাসায়নিক সমীকরণ
একটি রাসায়নিক বিক্রিয়ায়, যে পদার্থগুলো বিক্রিয়া করে সেগুলোর অণুগুলোর ভেতর যে বন্ধন থাকে সেগুলো ভেঙে নতুন পদার্থ গঠিত হয় এবং উৎপন্ন পদার্থের অণুগুলোর মধ্যে নতুন বন্ধন তৈরি হয়। রাসায়নিক বিক্রিয়া বর্ণনা করার সময় আমরা রাসায়নিক সমীকরণ দিয়ে এই বিক্রিয়াকে প্রকাশ করি।
একটি রাসায়নিক বিক্রিয়াকে দুইটি অংশে ভাগ করা যায়, এক অংশে বিক্রিয়ক এবং অন্য অংশে বিক্রিয়ার ফলে নবগঠিত পদার্থ থাকে। সমীকরণ দিযয়ে প্রকাশ করার সময় বিক্রিয়কগুলো সমীকরণের বাম দিকে থাকে এবং একটি তীর চিহ্ন দিযয়ে ডানদিকে বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন নতুন পদার্থগুলো দেখানো হয়।
রাসায়নিক বিক্রিয়ায় কোনো পরমাণু তৈরি বা ধ্বংস করা যায় না, শুধু তাদের পুনর্বিন্যাস ঘটে। অতএব, বিক্রিয়ার আগে বিক্রিয়ায়কগুলোতে যে পরমাণুগুলো যতগুলো করে থাকে, বিক্রিয়ার পর উৎপন্ন পদার্থেও ঠিক সেই পরমাণুগুলো ততগুলো করে থাকে। কাজেই এই আলোচনা থেকে বলা যায় যে, কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী বিক্রিরক এবং উৎপন্ন পদার্থকে প্রতীক, সংকেত ও কিছু গাণিতিক চিহ্ন ব্যবহার করে সংক্ষেপে প্রকাশ করাকে রাসায়নিক সমীকরণ বলে।
রাসায়নিক বিক্রিয়া ও রাসায়নিক পরিবর্তন
রাসায়নিক পরিবর্তন বলতে বোঝানো হয় এক বা একাধিক পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন এক বা একাধিক পদার্থে পরিবর্তিত হওয়া। রাসায়নিক পরিবর্তনের সময় বিক্রিয়কের অণু-পরমাণুগুলো নতুনভাবে বিন্যস্ত হয়, যে কারণে এই নতুন পদার্থের সৃষ্টি হয়। রাসায়নিক পরিবর্তনে প্রায় সময়েই শক্তি বিনিময় হযয়ে থাকে, কখনো তাপ সৃষ্টি হয় কখনো তাপ শোষিত হয়, যার ফলে বিক্রিয়ক এবং বিক্রিয়াজাত পদার্থের তাপমাত্রার পরিবর্তন হয়।
রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে যে নতুন পদার্থ তৈরি হয় প্রায় সময়েই সেগুলোর ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম ভিন্ন এবং এই পরিবর্তন সাধারণত অপ্রত্যাবতী (রৎৎবাবৎংরনষব)। রাসায়নিক বিক্রিয়া নানাভাবে সংগঠিত হতে পারে। এখানে সংক্ষেপে সংযোজন, দহন, প্রতিস্থাপন এবং বিয়োজন বিক্রিয়া আলোচনা করা হলো।
সংযোজন বিক্রিয়া (অফফরঃরড়হ ৎবধপঃরড়হ) :
সংযোজন বিক্রিয়া হচ্ছে এমন একটি রাসায়নিক বিক্রিয়া যেখানে দুই বা ততধিক বিক্রিয়ক (ৎবধপঃধহঃ) একত্রিত হযয়ে নতুন একটি বিক্রিয়াজাত পদার্থ (ঢ়ৎড়ফঁপঃ) তৈরি করে। ল্যাবরেটরির নিরাপদ পরিবেশে একটি টেস্ট টিউবে লোহার গুঁড়া এবং সালফার পাউডার একসঙ্গে মিশিয়ে উত্তপ্ত করলে দুটি বিক্রিয়ক (আয়রন এবং সালফার) একত্রিত হযয়ে বিক্রিয়াজাত পদার্থ ফেরাস সালফাইড তৈরি হয়। টেস্ট টিউব থেকে যে বস্তু পাওয়া যায় সেটি দেখতে গাঢ় ধূসর বর্ণের, এখানে
হালকা হলুদ রঙের সালফার বা লোহার (আয়রন) গুঁড়া কোনোটিই দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ, এখানে আয়রন ও সালফার একে অপরের সাথে মিলে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী নতুন পদার্থ ফেরাস সালফাইড (ঋবঝ) তৈরি করেছে।
ঋব + ঝ ম ঋবঝ
হ পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়