শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

অষ্টম শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ

হাবিবুর রহমান বাপ্পা, সহকারী শিক্ষক, শহীদ বীর-উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজ, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট
  ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
অষ্টম শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ

তরঙ্গের ধারণা

তোমরা সবাই পানিতে ঢেউ সৃষ্টি হতে দেখেছ। পুকুরের পানিতে একটা ঢিল ছুড়লে যেখানে ঢিলটি পড়ে সেই বিন্দু থেকে বৃত্তাকারে একটি তরঙ্গ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। নদী দিয়ে একটা লঞ্চ গেলে তার ঢেউ নদী অতিক্রম করে একটু পরে তীরে এসে আঘাত করে।

কোথাও একটা দড়ি বেঁধে দড়ির অন্য মাথায় একটা ঝাঁকুনি দিলে দড়ির একটা ঢেউকে দড়ি বেয়ে যেতে দেখবে। একটা লম্বা স্প্রিং টান টান করে রেখে তার এক মাথা খানিকটা সংকুচিত করে ছেড়ে দিলে তুমি সেই সংকোচনকে স্প্রিংয়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে দেখবে।

এর সবগুলোই এক ধরনের তরঙ্গ এবং প্রতিটি উদাহরণের বেলায় আমরা দেখেছি কোনো এক ধরনের শক্তি প্রয়োগ করে একটি তরঙ্গ সৃষ্টি করা হয় এবং সেই তরঙ্গটি একটি মাধ্যমের ভেতর দিয়ে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে সেই শক্তিটুকু বহন করে নিয়ে যায়। তবে তরঙ্গের বেলায় যেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সেটি হচ্ছে, যদিও মাধ্যমটি তরঙ্গের মাধ্যমে শক্তিকে একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় মাধ্যমটি কিন্তু তার স্থান পরিবর্তন করছে না। আমাদের উদাহরণের দড়ি, পানি কিংবা স্প্রিং কোনোটাই কিন্তু নিজের জায়গা ছেড়ে যাচ্ছে না অথচ তার ভেতর দিয়ে তরঙ্গের স্পন্দন আরেক মাথায় পৌঁছে যাচ্ছে। আমরা সবাই শব্দের কথা জানি, শব্দ আমরা চোখে দেখতে পাই না কিন্তু সেটিও আসলে এক ধরনের তরঙ্গ এবং সেটিও বাতাসকে মাধ্যমে হিসেবে ব্যবহার করে একস্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছায়, কিন্তু বাতাস তার স্থান পরিবর্তন করে না।

তরঙ্গ ও সরল স্পন্দন গতি

তোমরা যারা পুকুরে ঢিল ছুড়ে পানিতে ঢেউ সৃষ্টি করেছ তারা তরঙ্গের মাধ্যমে শক্তি স্থানান্তরের বিষয়টা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবে। পুকুরের পাড় থেকে আমরা যখন ঢিল ছুড়ে দেই, তখন ঢিলটি যেহেতু একটি গতিতে ছুটে যায় কাজেই তার একটি গতিশক্তি থাকে।

এই শক্তি নিয়ে ঢিলটি যখন পানির পৃষ্ঠে আছড়ে পড়ে, তখন এ স্থানের পানির কণাগুলোতে সেই শক্তি স্থানান্তরিত হয়ে সেখানে একটা স্পন্দনের সৃষ্টি হয়। সেই স্পন্দনটি তার পাশের পানির কণাগুলোতে একটি স্পন্দন তৈরি করে, যেটি আবার তার পাশের কণাগুলোতে স্পন্দন তৈরি করে। এভাবে স্পন্দনটি ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং আমরা দেখতে পাই, কেন্দ্র থেকে বৃত্তের মতো একটি ঢেউ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।

যদি পুকুরে কোনো কচুরিপানা ভেসে থাকে তাহলে দেখবে তার নিচে দিয়ে ঢেউটি যাওয়ার সময় কচুরিপানাটি নিজের জায়গাতেই উপরে নিচে করেছে কিন্তু ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসেনি। অর্থাৎ, মাধ্যম নিজে সরেনি, শুধু নিজের স্থানে স্পন্দিত হয়ে তরঙ্গটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, অর্থাৎ শক্তিটি পৌঁছে দিয়েছে।

তোমরা এবারে নিশ্চয়ই তরঙ্গের সঙ্গে সরল স্পন্দন গতির সম্পর্কটা বুঝতে পারবে। যখন কোনো মাধ্যমের ভেতর দিয়ে একটি তরঙ্গ এগিয়ে যায় তখন তুমি যদি সেই মাধ্যমের কোনো একটি নির্দিষ্ট বিন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকো তাহলে তুমি সেই বিন্দুটির একটি সরল স্পন্দন গতি হতে দেখবে।

মাধ্যমের একটি বিন্দুর সরল স্পন্দন গতি হওয়ার সময়ে সেটি তার পাশের বিন্দুতে সরল স্পন্দন গতি সৃষ্টি করে এবং এভাবে একটি তরঙ্গ এগিয়ে যায়। সরল স্পন্দন গতি তরঙ্গ নয় কিন্তু তরঙ্গের প্রত্যেকটা বিন্দু আলাদা আলাদাভাবে একটি করে সরল স্পন্দন গতি।

যদিও আমরা তরঙ্গের প্রবাহের বেলায় একটি মাধ্যমের কথা বলেছি, কিন্তু কিছু তরঙ্গ আছে যার প্রবাহের জন্য মাধ্যমের প্রয়োজন হয় না। আলো সেরকম একটি তরঙ্গ এবং আমরা জানি সূর্য থেকে আলো মহাকাশের ভেতর দিয়ে কোনো মাধ্যম ছাড়াই পৃথিবীতে পৌঁছে যায়।

তরঙ্গের প্রকারভেদ

তরঙ্গের ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ যে, এখানে মাধ্যম তার নিজের অবস্থানে থেকেই কম্পনের মাধ্যমে শক্তিকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যায়। মাধ্যমের কণাগুলোর দু'ভাবে কম্পন হতে পারে। লম্বা একটা স্প্রিঙের একপ্রান্ত কোনো একটা জায়গায় শক্ত করে আটকে নিয়ে অন্য প্রান্তটি নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে সামনে পিছনে করলে তুমি দেখবে সংকোচন ও প্রসারণের একটি তরঙ্গ স্প্রিঙের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

এই সংকোচন ও প্রসারণ হচ্ছে স্প্রিঙের স্পন্দন। একটু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করে দেখ, এখানে তরঙ্গটি যেদিকে গেছে, স্প্রিঙের স্পন্দন বা কম্পনও সেই রেখা বরাবরই হয়েছে। এই ধরনের তরঙ্গকে 'অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ' (ষড়হমরঃঁফরহধষ ধিাব) বলা হয়। স্প্রিঙের তরঙ্গের মতো শব্দও একটি অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ, বাতাসে প্রসারণ ও সংকোচন করে শব্দ এগিয়ে যায়।

আবার মোটামুটিভাবে লম্বা একটা দড়ির একপ্রান্ত যদি কঠিন কোনো কিছুতে টানটান করে অন্যপ্রান্ত নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে উপরে নিচে কর তাহলে কী হবে? এবারেও তুমি একটা তরঙ্গকে দড়ির ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে দেখবে। তবে এবারে দড়িটি ঢেউয়ের মতো উপরে উঠে এবং নিচে নেমে তরঙ্গটিকে এগিয়ে নেবে।

একটু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করে দেখো, এখানে তরঙ্গটি যেদিকে গেছে, দড়িটির স্পন্দন বা কম্পন হয়েছে তার সাথে লম্বভাবে। এই ধরনের তরঙ্গকে 'অনুপ্রস্থ তরঙ্গ' বা (ঃৎধহংাবৎংব ধিাব) বলা হয়। পানির ঢেউ একটি অনুপ্রস্থ তরঙ্গ। আমরা আলো দেখতে পেলেও আলোর তরঙ্গটি দেখতে পাই না, সেটিও একধরনের অনুপ্রস্থ তরঙ্গ। তোমাদের আশপাশের যে নানা ধরনের তরঙ্গ রয়েছে তুমি কি তাদের ভেতর থেকে অনুপ্রস্থ আর অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গগুলো আলাদা করতে পারবে?

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে