শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

মায়ান সংখ্যা পদ্ধতির মায়াজাল

  ২৮ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
মায়ান সংখ্যা পদ্ধতির মায়াজাল

আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে ২৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বর্তমান ল্যাটিন আমেরিকায় মায়ান নামক মহাপরাক্রমশালী এক জাতিসত্তা বসবাস করত। হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা, এলসালভেদরের উত্তরাংশ, সেন্ট্রাল মেক্সিকো এবং চিয়াপাসসহ প্রায় এক হাজার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বসতি গড়ে তুলেছিল মায়ান সভ্যতার মানুষেরা। সমসাময়িককালে অন্যান্য ভৌগোলিক অঞ্চলের মানুষেরা যখন আবাসস্থল কীভাবে গড়তে হয় তা জানত না, ঠিক সেই সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে গিয়ে স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করে ফেলে মায়ানরা। যা বর্তমান মানুষের কাছে একটি বিস্ময়ের ব্যাপার। ইউরোপ যখন অন্ধকার যুগে নিমজ্জিত ঠিক সেই সময় ল্যাটিন আমেরিকায় বিকাশ লাভ করে মায়ান সভ্যতা। বর্তমান মেক্সিকানরা হচ্ছে মায়ানদের উত্তর পুরুষ। মায়ানদের শাসন ব্যবস্থাপনায় সব রাজ্যই ছিল নগর-রাজ্য।

ইউকাতানের চিচেন ইতসাই ছিল মায়ান সভ্যতার রাজধানী। জ্ঞান-বিজ্ঞানে যে সব প্রাচীন সভ্যতা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম হলো মায়ান সভ্যতা। মায়ান সভ্যতা বিশ্বের কয়েকটি সভ্যতার মধ্যে একটি যারা স্বাধীনভাবে একটি অবস্থানগত সংখ্যা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিল। ল্যাটিন আমেরিকার এই সভ্যতাটি সম্পর্কে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মানুষেরা জানতে পেরেছে মাত্র ৫০০ বছর আগে। মায়ান সভ্যতা সম্পর্কে লোকমুখে অনেক রহস্যময় কাহিনী প্রচলিত থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে মায়ান সভ্যতা পরিচিতি লাভ করে তাদের দিনপঞ্জিকার কারণে। অবাক করার বিষয় হলো মায়ান দিনপঞ্জিকায় ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের পর আর কোনো বর্ষ ছিল না। মায়ানরা বিশ্বাস করত ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের পর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। যদিও এই ধারণার সঙ্গে অনেক গবেষক দ্বিমত পোষণ করেছেন। এতকিছুর পরও সব গবেষক এই বিষয়ে একমত যে, মায়ান সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল স্বতন্ত্রভাবে। প্রাক-কলম্বিয়ান মায়ান সভ্যতার মায়ান সংখ্যা পদ্ধতিটি গণনার জন্য (ভিজেসিমাল) সিস্টেম ব্যবহার করেছিল।

এই সংখ্যা পদ্ধতি মূলত ছিল ২০ এবং পাঁচভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি। মায়ান সংখ্যা পদ্ধতিতে দশের পরিবর্তে ২০-এর ওপর ভিত্তি করে এর সব গাণিতিক কার্যক্রম সম্পাদন করা হতো। আমাদের প্রচলিত গাণিতিক সিস্টেমে ১, ১০, ১০০, এবং ১০০০-এর পরিবর্তে মায়ান সংখ্যা পদ্ধতিতে ১, ২০, ৪০০, ৮,০০০ এবং ১,৬০,০০০ ব্যবহার করা হতো। এর চাইতেও অবাক করার বিষয় হলো যে, মায়ানরা শূন্যের জন্য আলাদা প্রতীক ব্যবহার করত। ০, ১ ও ৫ এই তিনটি সংখ্যার জন্য তারা শুধু আলাদা প্রতীক ব্যবহার করত। সেদিক থেকে চিন্তা করলে মায়ানরা আধুনিক সংখ্যা পদ্ধতির খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। তবে যোগ-বিয়োগসহ অন্যান্য গাণিতিক কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য মায়ান সংখ্যা পদ্ধতি খুব একটা সুবিধার ছিল না। মায়ানরা লেখাকে দেবতার কাছ থেকে পাওয়া একটি পবিত্র উপহার বলে মনে করত। মায়ান সংখ্যা পদ্ধতি এক প্রকার অভিজাতশ্রেণি দ্বারা সংরক্ষিত ছিল বলে সাধারণ মায়ানরা লিখতে ও পড়তে পারত না। অভিজাতশ্রেণি এই মর্মে বিশ্বাসী ছিল যে, তারা সরাসরি দেবতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। তারা মনে করত দেবতা ও সাধারণ মানুষের মাঝে তারা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে। মায়ান সংখ্যা পদ্ধতিতে ব্যবহৃত লেখার পদ্ধতিটি আংশিকভাবে হায়ারোগিস্নফিক ছিল। কারণ এটি অক্ষরের পরিবর্তে পরিসংখ্যান ব্যবহার করত। সিলেবল এবং আইডিওগ্রামের ধ্বনিগত প্রতীকগুলোর সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়েছিল মায়ান সংখ্যা পদ্ধতি। মায়ান সংখ্যা পদ্ধতির লিপিগত পাঠোদ্ধার করা অত্যন্ত জটিল ও দূরূহ কাজ। স্প্যানিশ যাজকদের আদেশে তিনটি ব্যতীত অবশিষ্ট মায়ান কোডগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মায়ান সংখ্যা পদ্ধতির পাঠোদ্ধারে যে কোডগুলো এখনো সংরক্ষিত আছে সেগুলো হলো ড্রেসডেন কোডেক্স, প্যারিস কোডেক্স এবং মাদ্রিদ কোডেক্স। মায়ানরা জ্যোতির্বিজ্ঞানে অত্যন্ত দক্ষ ছিল এবং তাদের পর্যবেক্ষণ ছিল নির্ভুল। সমসাময়িক সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যদের চাইতে মায়ানরা জ্যোতির্বিজ্ঞানে অনেক দূর অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল। কোনো ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করেই তারা চাঁদ এবং গ্রহের গতিবিধির নির্ভুল পর্যবেক্ষণ করে দিতে পারত। সৌরবছরের দৈর্ঘ্য পরিমাপে ইউরোপের তুলনায় মায়ান সভ্যতা বেশি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। মায়ান সংখ্যা পদ্ধতিতে গাণিতিক ক্রিয়া-কলাপের চাইতে সময় পরিমাপকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এজন্য মায়ান সংখ্যা পদ্ধতির বেশিরভাগ নিদর্শন দিন, মাস এবং বছরের সঙ্গে সম্পর্কিত দিনপঞ্জিকাতে পাওয়া যায়। মায়ান সংখ্যা পদ্ধতিতে সংখ্যাগুলোকে বিশের মধ্যে গোষ্ঠীভুক্ত করা হয়েছে। মায়ান সংখ্যা পদ্ধতি যে তিনটি প্রতীক নিয়ে গঠিত তার মধ্যে প্রথমটি হলো একটি শেলসেপ (যা দ্বারা শূন্যকে প্রকাশ করা হয়, দ্বিতীয়টি একটি বিন্দু (.) যা দ্বারা ১-কে প্রকাশ করা হয়, তৃতীয় প্রতীকটি একটি দন্ড বা বার (-), যা দ্বারা পাঁচকে প্রকাশ করা হয়। মায়ান সংখ্যা পদ্ধতির প্রতিটি স্তরে বিশটি বিন্দুতে পৌঁছাতে হয়। মায়ান সংখ্যা পদ্ধতিতে এক-কে একটি বিন্দু দ্বারা, দুইকে দু'টি বিন্দু দ্বারা ৩-কে ৩টি বিন্দু দ্বারা, ৪-কে চারটি বিন্দু দ্বারা প্রকাশ করা হয় পাঁচ প্রকাশের জন্য একটি আনুভূমিক বার চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত দশমিক সংখ্যাগুলো মায়ান সংখ্যা পদ্ধতিতে প্রকাশ করতে বিন্দু চার বারের বেশি পুনরাবৃত্তি করা হয় না।

লেখক :মো. তাহমিদ রহমান

প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ)

নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিলস্না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে