প্রথম অধ্যায়
মনে রেখো কোনো বস্তু যখন গতিশীল অবস্থায় দিক পরিবর্তন করে তখন তার গড় নেওয়া হলে সেটির পরিমাণ আমাদের বিভ্রান্তিতে ফেলে দিতে পারে। ধরা যাক একটি বস্তু চলমান থেকে যেখান থেকে শুরু করেছিল ঠিক সেখানে ফিরে এসেছে, তাহলে বস্তুটির মোট সরণের মান শূন্য। কাজেই মোট সরণকে মোট সময় দিয়ে ভাগ করে গড় বেগ বের করা হলে তার পরিমাণ হবে শূন্য, যদিও চলমান অবস্থায় বস্তুটির বেগ কখনোই শূন্য ছিল না!
ত্বরণ ও মন্দন (অপপবষবৎধঃরড়হ ধহফ উবপবষবৎধঃরড়হ)
তোমাদের চারপাশে অনেক ধরনের গতি দেখেছ, কোনটা সোজা যাচ্ছে, কোনটা বাঁকা হয়ে যাচ্ছে, কোনটা বৃত্তাকারে ঘুরছে আবার কোনটা সামনে পিছনে কিংবা উপরে নিচে দুলছে। আপাতত এদের ভেতরে সবচেয়ে সহজ যে গতি- যেখানে কিছু একটা সরল রেখায় যাচ্ছে- আমরা তার মাঝে আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।
তোমরা এর মাঝে জেনে গেছ এই সরল রেখার গতিতে দ্রম্নতি আর বেগের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই, এবং যেহেতু সরল রেখায় যাচ্ছে তাই দিকটিও একেবারে সুনির্দিষ্ট, সেজন্য আমরা যখন বেগের কথা বলব তখন আলাদাভাবে আর আমাদের বেগের দিকটি উলেস্নখ করারও কোনো প্রয়োজন নেই।
গতিশীল বস্তুর বেগ বেড়ে যাওয়া কিংবা কমে যাওয়া একটি অত্যন্ত পরিচিত বিষয়। তোমরা নিশ্চিতভাবেই সাইকেল, গাড়ি, বাস কিংবা ট্রেনে উঠেছ যেখানে স্থির অবস্থা থেকে বেগ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে, কিংবা উল্টোটা ঘটেছে, অর্থাৎ বেগ ধীরে ধীরে কমে এসেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেগ বেড়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে বলে ত্বরণ এবং কমে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে বলে মন্দন।
অবস্থানের পরিবর্তন মাপতে আমরা 'সরণ' ব্যবহার করেছি। আবার সেই সরণ দ্রম্নত না ধীরে ঘটছে, সেটি মাপতে গিয়ে আমরা 'বেগ' পেয়েছি। ঠিক একইভাবে বেগের পরিবর্তন কি দ্রম্নত হচ্ছে না ধীরে হচ্ছে, এটি পরিমাপ করতে গিয়ে আমরা ত্বরণ এবং মন্দন পেয়েছি। অর্থাৎ একক সময়ে বেগের পরিবর্তন হচ্ছে ত্বরণ। যদি প্রথমে কোনো একটা বস্তুর বেগ থাকে ঁ এবং : সময় পরে তার বেগ হয় া তাহলে বেগের পরিবর্তন হচ্ছে া-ঁ এবং তার ত্বরণ ধ হবে, ধ = (া ু ঁ)/ঃ
বেগ সম্পর্কে বলতে হলে যেরকম তার পরিমাণ এবং দিক দুটিই নির্দিষ্ট করে দিতে হয় ঠিক সেরকম ত্বরণের বেলাতেও তার পরিমাণ এবং দিক দুটিই নির্দিষ্ট করে দিতে হয়।
দ্বিতীয় অধ্যায়
আমরা সবাই দেখেছি বল প্রয়োগ করে একটি বস্তুকে ঠেলে সরিয়ে নেয়া যায়। কতটুকু বল প্রয়োগ করে কতটুকু সরানো হয়েছে তার উপর নির্ভর করে কতটুকু কাজ করা হয়েছে। 'কাজ' শব্দটি আমরা আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তায় সবসময় ব্যবহার করি, কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় কাজ শব্দটির একটা সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে। বল প্রয়োগ করে যদি বলের দিকে একটা বস্তুকে ঠেলে নেওয়া যায় শুধু তাহলে ধরে নেওয়া হয় যে কাজ করা হয়েছে।
কাজ ও শক্তি (ডড়ৎশ ধহফ ঊহবৎমু)
মনে করো, তুমি একটি ইট ধাক্কা দিয়ে ৫ মিটার দূরে সরিয়ে নিয়েছ, তোমার বন্ধ সেই একই ইট একই
পরিমাণ ধাক্কা দিয়ে ১০ মিটার দূরে সরিয়ে নিযয়েছে। দুজনেই একই পরিমাণ বল প্রয়োগ করেছ, কিন্তু দুজনেই 'ইট সরিয়েছ' ভিন্ন ভিন্ন দূরত্বে, কাজেই দুজনের 'কাজ' হয়েছে দুরকম।
একইভাবে দুজনেই যদি ধাক্কা দিয়ে ইটটিকে সমান দূরত্বে সরাতে কিন্তু সরানোর জন্য ভিন্ন পরিমাণ বল প্রয়োগ করাতে তাহলেও কিন্তু কাজের পরিমাণ ভিন্ন হতো অন্যভাবে বলা যায় কাজের পরিমাণ বের করার জন্য বল এবং সরণ এই দুটি রাশি প্রয়োজন। প্রথমত, একটি বস্তুতে 'বল' প্রয়োগ করতে হবে, এবং সেই বল প্রয়োগ করে বস্তুটির 'সরণ' ঘটতে হবে। অর্থাৎ, গাণিতিকভাবে বলা যায় বল ও সরণের গুণফলই হলো কাজ।
কাজ করতে প্রয়োজন হয় শক্তির। আমরা সবাই শক্তি কথায় আমাদের শক্তি প্রয়োগ বা বল প্রয়োগ বলতে একই বিষয় বুঝিয়ে থাকি। কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় শক্তি (ঊহবৎমু) শব্দটির একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে। কাজ করার সামর্থ্যকে বলা হয় শক্তি। শক্তিকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না, এক ধরনের শক্তি কেবল অন্য ধরনের শক্তিতে বদলে যেতে পারে। বইয়ের ভাষায় একে বলে শক্তির নিত্যতা। আর এক শক্তি থেকে অন্য শক্তিতে বদলে যাওয়াকে বলে শক্তির রূপান্তর।
একটু আগে তোমাদের বল প্রয়োগ করে একটি ইট সরিয়ে কাজ করার কথা বলা হয়েছে। এই কাজের সামর্থ্য এসেছে তোমার হাত থেকে। তোমার হাতে এই শক্তি এসেছে তোমার দেহে সঞ্চিত রাসায়নিক শক্তি থেকে। তোমার দেহে রাসায়নিক শক্তি এসেছে তোমার খাবার থেকে। খাবার হিসেবে তুমি ভাত বা রুটি খেয়ে থাকলে সেটি এসেছে ধানগাছ কিংবা গমগাছ থেকে। মাংস হলে এসেছে হাঁস, মুরগি কিংবা গরু-ছাগলের মতো কোনো প্রাণী থেকে। প্রাণীরাও বড় হয়েছে ঘাস, পাতা বা বিচালি খেয়ে।
ঘাস, পাতা কিংবা অন্যান্য গাছের শক্তি এসেছে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সালোকসংশ্লেষণের জন্য প্রয়োজন হয় আলো, সেটি আসে সূর্য থেকে। সূর্য তার এই শক্তি পেয়ে থাকে ক্রমাগত চলমান ফিউশান নামের নিউক্লিয় বিক্রিয়া থেকে। এভাবে এক শক্তি থেকে অন্য শক্তির রূপান্তর হতেই থাকে। শক্তি যেহেতু কাজেরই পরিমাণ, তাই এর এককও জুল।
বিভবশক্তি (চড়ঃবহঃরধষ ঊহবৎমু)
আমরা ইতোমধ্যে শক্তির বিভিন্ন উদাহরণ দেখেছি। আমরা এটাও জেনেছি যে কাজ করার সামর্থ্য হচ্ছে শক্তি। কিছু শক্তি আছে যা কাজের মাধ্যমে সঞ্চয় করে রাখা যায়। একটা ইলাস্টিক কিংবা রাবার ব্যান্ড টেনে লম্বা করে ছেড়ে দিয়ে সেটা দিয়ে কিছু ছুড়ে দেওয়া যায়, গুলতিতে যা করা হয়।
স্প্রিং দিয়েও একই ধরনের কাজ করা যায়, তাকে টেনে লম্বা কিংবা চেপে সংকুচিত করে তার ভেতর শক্তি সঞ্চয় করে রাখা যায়। একটা স্প্রিং কিংবা রাবার ব্যান্ড নিজে নিজে লম্বা হয় না, বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করে একে লম্বা করতে হয়। এই লম্বা করার প্রক্রিয়ায় যে কাজ করা হয় সেটি রাবার ব্যান্ড কিংবা স্প্রিঙের ভেতরে শক্তি হিসেবে জমা হয়ে থাকে।
পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়