দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) বাংলা ভাষার প্রধান কবি। সাহিত্যের সকল শাখায় তিনি অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর উলেস্নখযোগ্য বইয়ের নাম 'সোনারতরী', 'বলাকা', 'পুনশ্চ', 'গল্পগুচ্ছ', 'গোরা', 'কালান্তর', 'ডাকঘর' ইত্যাদি। ১৯১৩ সালে 'গীতাঞ্জলী' কাব্যের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। নিচে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নদী' কাব্যের কিছু অংশ সংকলিত হলো।
নদী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নদী যত আগে আগে চলে
ততই সাথি জোটে দলে দলে।
তারা তারি মতো, ঘর হতে
সবাই বাহির হয়েছে পথে।
পায়ে ঠুনুঠুনু বাজে নুড়ি,
যেনে বাজিতেছে মল চুড়ি।
গায়ে আলো করে ঝিকিঝিক,
যেনে পরেছে হীরার চিক।
মুখে কলকল কত ভাষে
এত কথা কোথা হতে আসে।
শেষে সখীতে সখীতে মেলি
হেসে গায়ে গায়ে হেলাহেলি।
শেষে কোলাকুলি কলরবে
তারা এক হয়ে যায় সবে।
তখন কলকল ছুটে জলপথ
কাপে টলমল ধরাতল,
কোথাও নিচে পড়ে ঝরঝর-
পাথর কেঁপে ওঠে থরথর,
শিলা খানখান যায়
নদী চলে পথ কেটে কুটে।
ধারে গাছগুলো বড়ো বড়ো
তারা হয়ে পড়ে পড়ো -পড়ো।
কত বড়ো পাথরের চাপ
জলে খসে পড়ে ঝুপঝাপ।
তখন মাটি-গোলা ঘোলা জলে
ফেনা ভেসে যায় দলে দলে।
জলে পাক ঘুরেঘুরে ওঠে,
যেনে পাগলের মতো ছোটে।
কোথাও ধু ধু করে বালুচর
সেখায় গাঙশালিকের ঘর।
সেথায় কাছিম বালির তলে
আপন ডিম পেড়ে আসে চলে।
সেথায় শীতকালে বুনো হাঁস
কত ঝাঁকে ঝাঁকে করে বাস।
সেখায় দলে দলে চখাচখি
করে সারাদিন বকাবকি।
সেথায় কাদাখোঁচা তীরে তীরে
কাদায় খোঁচা দিয়ে দিয়ে ফিরে।
নদী চলেছে ডাহিনে বামে,
কভু কোথাও সে নাহি থামে।
সেখায় গহন গভীর বন,
তীরে নাহি লোক নাহি জন।
শুধু কুমির নদীর ধারে
সুখে রোদ পোহাইছে পাড়ে।
বাঘ ফিরিতেছে ঝোপে ঝোপে,
ঘাড়ে পড়ে আসি এক লাফে।
কোথাও দেখা যায় চিতাবাঘ,
তাহার গায়ে চাকাচাকা দাগ।
রাতে চুপিচুপি আসে ঘাটে,
জল চকো চকো করি চাটে।
হেথায় যখন জোয়ার ছোটে,
নদী ফুলিয়ে ঘুলিয়ে ওঠে।
তখন কানায় কানায় জল,
কত ভেসে আসে ফুল ফল
ঢেউ হেসে ওঠে খলখল,
তরী করি ওঠে টলমল।
নদী অজগরসম ফুলে
গিলে খেতে চায় দুই কূলে।
আবার ক্রমে আসে ভাঁটা পড়ে
তখন জল যায় সরে সরে।
কাদা দেখা দেয় দুই পাশে।
বেরোয় ঘাটের সোপান যত
যেনে বুকের হাড়ের মতো।
শব্দের অর্থ
অজগরসম : অজগরের মতো।
টুটা : ভাঙা।
কানায় কানায়: পরিপূর্ণ।
ধরাতল : পৃথিবী।
গহন : নিবিড়।
চিক : গলায় পরার অলংকার।
সোপান : সিঁড়ি।
শব্দদ্বিত খুঁজি
'নদী' কবিতায় এমন কিছু শব্দের প্রয়োগ আছে যেগুলো একই রকমের দুটি শব্দ দিয়ে তৈরি; যেমন কল+কল = কলকল। কিছু শব্দ আবার সামান্য
বদলে ভিন্ন রকম হয়েছে; যেমন হেলা+হেলি = হেলাহেলি। আবার কিছু শব্দ পাশাপাশি দুইবার এসেছে; যেমন ঘুরে+ঘুরে = ঘুরে
ঘুরে ঘুরে। কবিতাটি থেকে এই ধরনের অন্তত দশটি শব্দ খুঁজে বের করো এবং নিচে লেখো। লেখা শেষ হলে সহপাঠীর সঙ্গে মেলাও এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো।
শব্দদ্বিত
অভিন্ন বা সামান্য পরিবর্তিত চেহারায় কোনো শব্দ পরপর দুইবার ব্যবহৃত হলে তাকে শব্দদ্বিত্ব বলে। শব্দদ্বিত তিন ধরনের : ধ্বন্যাত্মক দ্বিত্ব, অনুকার দ্বিত্ব ও পুনরাবৃত্ত দ্বিত্ব।
ক. ধ্বন্যাত্মক দ্বিত : কোনো প্রাকৃতিক ধ্বনির অনুকরণে যেসব শব্দ তৈরি হয়, সেগুলোকে ধ্বন্যাত্মক শব্দ বলে। একাধিক ধ্বন্যাত্মক শব্দ মিলে ধ্বন্যাত্মক দ্বিত তৈরি হয়। যেমন, কোনো ধাতব পদার্থের সঙ্গে অন্য কিছুর সংঘর্ষে 'ঠন' ধ্বনি শোনা যায়। এই 'ঠন' একটি ধ্বন্যাত্মক শব্দ। 'ঠন' শব্দটি পরপর দুবার ব্যবহৃত হলে 'ঠন ঠন' ধ্বন্যাত্মক দ্বিত্ব সৃষ্টি হয়।
অনেক সময়ে কল্পিত ধ্বনির ভিত্তিতেও ধ্বন্যাত্মক দ্বিত্ব তৈরি হতে পারে। যেমন- টনটন, ছমছম।
কয়েকটি ধ্বন্যাত্মক দ্বিত্বের উদাহরণ : কুট কুট, কোঁত কোঁত, কুটুস-কুটুস, খক খক, খুটুর-খুটুর, টুং টুং, ঠুক ঠুক, ধুপ ধুপ, দুম দুম, ঢং ঢং, চকচক, জ্বলজ্বল, ঝমঝম, টসটস, থকথকে, ফুসুর ফাসুর, ভটভট, শোঁ শোঁ, হিস হিস।
খ. অনুকার দ্বিত : পরপর প্রয়োগ হওয়া কাছাকাছি চেহারার শব্দকে অনুকার দ্বিত্ব বলে। এতে প্রথম শব্দটি অর্থপূর্ণ হলেও প্রায় ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শব্দটি অর্থহীন হয় এবং প্রথম শব্দের অনুকরণে তৈরি হয়। যেমন : অঙ্ক-টঙ্ক, চুপচাপ ইত্যাদি। অনুকার দ্বিত্বের দ্বিতীয় অংশে ব্যঞ্জনধ্বনির পরিবর্তন ঘটে; যেমন:
অঙ্ক-টঙ্ক, আম-টাম, কেক-টেক, ঘর-টর, গরু-টরু, ছাগল-টাগল, ঝাল-টাল, হেন-তেন, লুচিফুচি, টাট্টু-ফাট্টু, আগড়ম-বাগড়ম, এলোমেলো, ঝিকিমিকি, কচর-মচর, ঝিলমিল, শেষ-মেষ, অল্পসল্প, বুদ্ধিশুদ্ধি, গুটিশুটি, মোটাসোটা, নরম-সরম, ব্যাপার-স্যাপার, বুঝে-সুঝে।
হ পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়