রচনামূলক প্রশ্নোত্তর
ছ. 'বাংলা নববর্ষ' রচনাটিকে প্রবন্ধ কেন বলব? বুঝিয়ে লেখো।
উত্তর: 'বাংলা নববর্ষ' রচনাটি পড়ে আমরা বাংলা নববর্ষ সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পারি। এখানে পহেলা বৈশাখে বাঙালির চিরাচরিত অনুষ্ঠানগুলোর বর্ণনা দেওয়ার পাশাপাশি নববর্ষের রাজনৈতিক দিকগুলো উঠে এসেছে। রচনাটি পড়ে আমরা পুণ্যাহ, হালখাতা, বৈশাখী মেলা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের বিবরণ জানতে পেরেছি। নাতিদীর্ঘ কলেবরে বাংলা নববর্ষের অন্যান্য অনুষ্ঠানের তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে। তথ্য বর্ণনা করতে লেখক নিজের সৃজনশীলতার পরিচয় রেখেছেন। রচনাটি একটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছে। একটি আদর্শ প্রবন্ধের সকল বৈশিষ্ট্য বিরাজমান থাকায় বাংলা নববর্ষ' রচনাটিকে আমরা প্রবন্ধ বলব।
জ. একটি প্রবন্ধ লেখার সময় তোমাকে কী কী বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করতে হবে তা বুঝিয়ে লেখো।
উত্তর: প্রবন্ধ হলো এমন এক ধরনের গদ্য রচনা যা পাঠকের জ্ঞানতৃষ্ণাকে পরিতৃপ্ত করে। প্রবন্ধ রচনার সময় আমাকে নিম্নে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলো অনুসরণ করতে হবে।
ক. প্রবন্ধ অবশ্যই গদ্য ভাষায় রচিত হতে হবে।
খ. প্রবন্ধে লেখকের সৃজনশীলতার পরিচয় থাকতে হবে।
গ. প্রবন্ধ নাতিদীর্ঘ আকারে লিখিত হবে।
ঘ. পাঠকের জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাবে।
ঙ. প্রবন্ধে অনেক ধরনের তথ্য বিশ্লেষণ ও বিবরণ থাকবে।
চ. সাহিত্য যেভাবে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে ও মানুষকে আনন্দ দেয়, প্রবন্ধও তেমন হতে হবে।
ঝ. প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্যগুলো অনুসরণ করে যেকোনো বিষয়ে একটি প্রবন্ধ রচনা করো।
মঙ্গল শোভাযাত্রা
ঐতিহ্যের বাঙালি জাতি। এ কথা বলাটা সন্দেহাতীতভাবে যৌক্তিক। এ জাতির ভান্ডারে যেমন রয়েছে বিচিত্র জাতিসত্তার পরিচয়, তেমনি অনুষ্ঠানাদি পালনেও রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। বহুকাল থেকে বাঙালির নতুন বছরকে বরণ করার ঐতিহ্য রয়েছে। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন মহা উৎসবে মেতে ওঠে এ জনপদের মানুষ নানা কর্মসূচি এ দিনকে এক অনন্য মর্যাদায় আসীন করেছে। পহেলা বৈশাখ মানেই যেন ভিন্ন এক আমো, ভিন্ন অনুভূতি। একসময় হালখাতা, পুণ্যাহ, ভিন্ন ও। বৈচিত্র্যময় খাবারের আয়োজন হতো নতুন বছর উপলক্ষ্যে। শহর ও গ্রামের মানুষেরা নতুন পোশাক পরিধান করে বিভিন্ন মেলায় ঘুরে বেড়াতেন। তবে দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে পহেলা বৈশাখের উৎসব উদযাপনে ভিন্নতা এসেছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা তেমনি একটি আয়োজনের নাম।
নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। একসময় এর নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। রংবেরঙের চিত্রকর্ম ও পস্ন্যাকার্ড শোভা পায় এই শোভাযাত্রায়। বাঙালির সংস্কৃতির নানা দিক ফুটে ওঠে মঙ্গল শোভাযাত্রায় নামের মাঝেই এর উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। মাল বা কল্যাণ কামনার উদ্দেশ্যে এই আয়োজন করা হয়ে থাকে। অশুভ শক্তির বিনাশ সাধন করে শুভ বা কল্যাগের আগমনের প্রত্যাশায় এ শোভাযাত্রা বের করা হয়।
প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিল্পীরা এ বর্ণাঢ্য আয়োজন সফল করতে নতুন নতুন উপস্থাপনা নিয়ে হাজির হন। একটি বিষয় নির্ধারণ করে তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চিত্রকর্ম তৈরি করা হয়। চিত্র, মুখোশ ও নানা প্রতীকে ফুটিয়ে তোলা হয় প্রতিপাদ্য বিষয়কে। অশুভের বিনাশ কামনা করে সত্য ও সুন্দরের আহ্বান তুলে ধরা হয় শোভাযাত্রাটিতে।
১৯৮৫ সালে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয় যশোর থেকে। চারুশিল্পী মাহবুব জামাল শামীমের উদ্যোগে এটি বের করা হয়েছিল। তখন দেশে সামরিক শাসন চলছিল। গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত হয়ে স্বৈরশাসন জাতির জন্য অভিশাপম্বরূপ ছিল। সেখান থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে সেসময় এমন শোভাযাত্রার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এরপর ১৯৮৯ সালের পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয়। যদিও তখন এর নাম ছিল 'আনন্দ শোভাযাত্রা'। সেদিন এর মূলভাব ছিল 'অগণতান্ত্রিক শক্তির বিনাশ'।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন এই শোভাযাত্রায়। এখন প্রতিবছরই চারুকলার সামনে থেকে এটি বের হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। ১৯৮৯ সালের শোভাযাত্রায় স্থান পায় পাপেট ঘোড়া ও হাতি। ১৯৯০ সালে ছিল নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি। ১৯৯১ সালের শোভাযাত্রা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এতে চারুকলার শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিল্পীরা অংশ নেন। মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন আর বাঙালি জাতির উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর বর্ণাঢ্যতা, গুরুত্ব ও আয়োজনের পরিসর দেশ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও ছড়িয়ে পড়েছে।
২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায়। বাঙালি জাতি যে ঐতিহ্যের জাতি তা এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়। যদিও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অভিপ্রায়ে এই আয়োজনের সূচনা করা হয়নি। কিন্তু নববর্ষের প্রথম দিনকে এমন জমকালোভাবে উদযাপন সম্ভবত বিশ্বে বিরল ঘটনা। ঢাক, অসংখ্য মুখোশ খচিত নববর্ষের মিছিল ও নাচ-গানের অনন্য নিদর্শন আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক বিশ্লেষকদেরও ভাবাতে বাধ্য করেছে। ফলে বাংলাদেশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা সাড়া দেন। তাঁরা দেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইনস্টিটিউটের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও শিল্পীরা নিঃস্বার্থভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্যোগ নেন।
কোনো পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণ না করে নিজেদের চিত্রকর্ম বিক্রির টাকায় তারা বিভিন্ন মুখোশ, মূর্তি, টেপা পুতুল, নকশি পাখি, প্রাণীর প্রকৃতি তৈরি ও রং-তুলিতে সজ্জিত করেন। তাঁদের এমন সর্বজনীন আয়োজনে স্থান পায় ঘোড়া, নকশি পাখা, ফুল, প্রজাতি, মানুষ প্রভৃতি। তাই মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ। মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালি জাতির মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহু প্রাচীন। আমরাও পারি নববর্ষের উৎসবে ভিন্নমাত্রা যোগ করে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে দ্রোহ প্রকাশ করতে। আমাদের শোভাযাত্রা কোনো সাধারণ মিছিল নয়, অসত্য, অসুন্দরের মূলোৎপাটন করে সত্য ও সুন্দর প্রতিষ্ঠাই আমরা ধ্বনিত করি। জয় হোক সেই সত্যের।