দশম শ্রেণির বাংলা দ্বিতীয় পত্র

প্রকাশ | ১৩ জুন ২০২৪, ০০:০০

আতাউর রহমান সায়েম সহকারী শিক্ষক মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ
২০. পরের অভাব মনে করিলে চিন্তন আপন অভাব ক্ষোভ থাকে কতক্ষণ? ভাবসম্প্রসারণ : কোনো মানুষই চরমভাবে তুষ্ট নয়। সবার মনে অভাববোধের সীমাহীন ক্ষোভ বিদ্যমান। কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেকেই আছেন যারা তুলনামূলকভাবে অধিক বঞ্চনার জীবন-যাপন করে। তাদের অপ্রাপ্তির দিকে নজর দিলেই নিজের অভাবের গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে হ্রাস পায়। মানুষের আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই। তার চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। একটি অভাবের পরিতৃপ্তি নতুন অভাবের জন্ম দেয়। সেই অভাব পূর্ণ হলেও তৃপ্ত হয় না মানুষের মন। সব সময়েই অতুষ্টি আর অপ্রাপ্তির জ্বালা মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সে সব পেয়েছিল, দলে অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। এ অসম্ভব প্রচেষ্টা মানুষের মনে চরম ক্ষোভ ও যন্ত্রণার জন্ম দেয়। আর এ অপ্রত্যাশিত প্রচেষ্টা মানুষের সুকুমার বৃত্তিসমূহকে ধ্বংস করে তাকে স্বার্থপরতার দৃষ্টান্ত হিসেবে অভিষিক্ত করে। কিন্তু এ অবস্থা কারও কাম্য নয়। তা থেকে মুক্তি পেতে হলে তুলনামূলকভাবে যারা খুবই গরীব, বঞ্চিত জীবন-যাপন করে, তাদের দিকে নজর দিতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে- হযরত উমর ফারুক (রা.) জেরুজালেম যেতে মরুভূমি পথে উটের পিঠে চড়ে যাওয়ার সময় ভৃত্যের কষ্ট অনুভব করতে পেরে তাকে উটের পিঠে উঠতে বলেছিলেন। তাই নিজের অভাবের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে, অপরের বঞ্চনার দিকে তাকালে নিজের অপরিতৃপ্তির ক্ষোভ অনেকাংশে হ্রাস পায়। পায়ে জুতা না থাকলে দুঃখ হওয়া স্বাভাবিক; কিন্তু পা নেই এমন লোকের কথা চিন্তা করলে জুতা না থাকার ক্ষোভ ঘুচে যাবে। দুঃখ-কষ্টে জীবন-যাপন করেও যদি একজন অন্যের তুলনায় কতটা সুখে রয়েছে তা বিবেচনা করে তবে তার মনে আর দুঃখ থাকে না। পরের দুঃখ ও অপ্রাপ্তির কথা চিন্তা করলে নিজেকে অধিকতর সুখী মনে হয়। তাতে অপ্রাপ্তির ক্ষোভ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তৃপ্ত জীবন-যাপন করতে হলে আত্মতুষ্টির কোনো বিকল্প নেই। আর আত্মতুষ্টি লাভ ও অপ্রাপ্তির জ্বালা থেকে মুক্তি পেতে হলে অন্যের অপ্রাপ্তিকে বিবেচনায় আনতে হবে। ২১. দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য। ভাবসম্প্রসারণ : বিদ্বান ব্যক্তি সর্বত্র সম্মানিত। কিন্তু দুর্জন অর্থাৎ খারাপ প্রকৃতির লোক বিদ্বান হলেও সে সমাজের দুশমন। সকলেই তাকে ঘৃণা করে। বিদ্যার মতো মূল্যবান সম্পদ আর নেই। বিদ্বান ব্যক্তিকে সকলেই সম্মান করে। বিদ্বানের সংস্পর্শে এলে জ্ঞানের আলোয় মন আলোকিত হয়। এতে চরিত্র গঠনের সুযোগ ঘটে। বিদ্যার আলোয় মানুষের জীবনের অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হয়। বিদ্যা মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বিদ্বানের ভূমিকায় সমাজ ও দেশ সমৃদ্ধির আলোয় আলোকিত হয়। বিদ্যার সম্মোহনী শক্তি যেমন ব্যক্তি জীবন থেকে দূর করে সংকীর্ণতা ও কলুষতার অন্ধকার, তেমনি তা সমাজকেও করে প্রগতির আলোয় আলোকিত। কিন্তু বিদ্বান ব্যক্তি যদি দুর্জন অর্থাৎ খারাপ প্রকৃতির হয়, তবে তার অর্জিত বিদ্যার কোনো মূল্য থাকে না। সমাজ, দেশ বা জাতি কেউ এদের দ্বারা উপকৃত হয় না। সকলেই তাকে ঘৃণা করে। এ প্রসঙ্গে জনৈক দার্শনিকের মন্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য : 'ঊাবৎু সধহ যধং ভরাব ংবহংব. ঈড়সসড়হংবহংব রং হড়হব ড়ভ :যবস. ইঁঃ রিঃযড়ঁঃ রঃ ধ সধহ :ঁৎহং রহঃড় ধ হড়হংবহংব.' অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষের পাঁচটি ইন্দ্রিয় (নাক, কান চোখ, জিহ্বা ও ত্বক) আছে। বিবেক এই ইন্দ্রিয়গুলো থেকে আলাদা। কিন্তু এটা ছাড়া একজন মানুষ পশুতে পরিণত হয়ে যায়। অর্থাৎ দুর্জন বিদ্বান হলেও সে বিবেকহীন পশুর মতো হয়ে যায়। দুর্জন ব্যক্তি সাপের সঙ্গে তুলনীয়। তার অর্জিত বিদ্যার তুলনা করা চলে সাপের মাথার মণির সঙ্গে। মানুষ সাপকে ভয় করে। কাছে গেলেই জীবননাশ সুনিশ্চিত। প্রাণনাশের ভয়ে কেউ সাপের মাথার মূল্যবান মণি আনতে সাহস পায় না। বিদ্বান ব্যক্তি যদি খারাপ প্রকৃতির হয়, তবে সেও সাপের মতো ভয়াবহ। তার কাছ থেকে বিদ্যা লাভের প্রত্যাশা জীবননাশ তথা ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সমাজে দুর্জনের স্থান নেই। সে বিদ্বান হলেও সর্বত্র ঘৃণিত ও পরিত্যাজ্য। ২২. সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। ভাবসম্প্রসারণ : মানুষে মানুষে অনেক ধরনের বিভেদ-বৈষম্য থাকতে পারে। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে আমরা সবাই মানুষ। সব মানুষ একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। সৃষ্টির মধ্যে মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ। পৃথিবীর একই জল-হাওয়ায় আমরা বেড়ে উঠি। আমাদের সবার রক্তের রং লাল। তাই মানুষ একে অন্যের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। ভৌগোলিকভাবে আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন, অথবা আমরা যে যুগেরই মানুষ হই না কেন, আমাদের একটিই পরিচয়- আমরা মানুষ। আমরা কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'মানুষ' কবিতা, ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের 'মানুষ জাতি' কবিতা কিংবা বাউল সাধক লালন ফকিরের 'মানবধর্ম' গানেও একই সুর পাওয়া যাচ্ছে। আর সেটা হচ্ছে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। কখনো কখনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমরা জাত-কুল-ধর্ম-বর্ণের পার্থক্য তৈরি করে মানুষকে দূরে ঠেলে দিই, এক দল আরেক দলকে ঘৃণা করি, পরস্পর হানাহানিতে লিপ্ত হই। কিন্তু এগুলো আসলে সাময়িক। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, আমরা একে অন্যের পরম সুহৃদ। আমাদের উচিত সবাইকে ভ্রাতৃত্ব্বের বন্ধনে আবদ্ধ রাখা। প্রত্যেককে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়া এবং তার অধিকার সংরক্ষণে একনিষ্ঠ থাকা। মানুষের মধ্যে নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, আশরাফ-আতরাফ, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, কেন্দ্রবাসী-প্রান্তবাসী এমন ভাগাভাগি কখনোই কাম্য হতে পারে না। তাতে মানবতার অবমাননা করা হয়। তাই আধুনিককালে এক বিশ্ব, এক জাতি চেতনার বিকাশ ঘটছে দ্রম্নত। মানবজাতির একই একাত্ম-ধারণা প্রতিষ্ঠিত হলে যুগে যুগে, দেশে দেশে মারামারি, যুদ্ধ-বিগ্রহ কমে আসবে। মানুষ সংঘাত-বিদ্বেষমুক্ত শান্তিপূর্ণ এক বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। সর্বত্র মনুষ্যত্বের জয়গাথা ঘোষিত হবে। সব ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে, বিশুদ্ধভাবে ভালোবাসতে পারলেই বিশ্বে প্রার্থিত সুখ ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হবে।