১৮. লাইব্রেরি জাতির সভ্যতা ও উন্নতির মানদন্ড।
ভাবসম্প্রসারণ : লাইব্রেরি হচ্ছে জ্ঞানের আধার। একটি জাতির রুচির পরিশুদ্ধ, জ্ঞানের গভীরতা ও সভ্যতার অগ্রগমন সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় ওই জাতির লাইব্রেরির মাধ্যমে। তাই জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান-অন্বেষণ, গবেষণার ক্ষেত্রে ও জাতির ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে লাইব্রেরির গুরুত্ব অপরিসীম।
লাইব্রেরির বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে গ্রন্থাগার। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ভাষায়- 'পুস্তকের শ্রেণিবদ্ধ সংগ্রহকে লাইব্রেরি বলা হয়।' লাইব্রেরি তিন প্রকার- ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সাধারণ। ব্যক্তিগত লাইব্রেরি যেমন ব্যক্তির ইচ্ছার প্রতিবিম্ব, পারিবারিক লাইব্রেরি তেমনি পরিবারের অন্তর্গত ব্যক্তিগুলোর সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রতিচ্ছায়া। আর সাধারণ লাইব্রেরি দশজনের রুচির দিক নজর রেখেই সাধারণ লাইব্রেরি গঠিত হয়। একটি জাতি বা দেশের সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, খেলাধুলা-বিনোদন, সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিচয়কে ধারণ করে সেই জাতির সযত্ন তৈরি লাইব্রেরি। কখনো কখনো মানুষের মুখ যেমন ব্যক্তির অন্তর্গত রূপ বা পরিস্থিতিকে নির্দেশ করে, তেমনি লাইব্রেরি জাতির উন্নতি ও অগ্রগতিকে চিহ্নিত করে। লাইব্রেরি জাতির অতীত ও বর্তমানকে এক সুতোয় বেঁধে রাখে এবং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেয়। জ্ঞানান্বেষী ও সত্যসন্ধানী মানুষ লাইব্রেরিতে এসে নিজেকে সমৃদ্ধ করে এবং জাতির সভ্যতার ক্রমোন্নতিতে ভূমিকা রাখে।
একটি লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত সাহিত্যগ্রন্থ দেখে সংশ্লিষ্ট জাতির সাহিত্যরুচি উপলদ্ধি করা যায়, বিজ্ঞানগ্রন্থ দেখে জাতির বিজ্ঞান-চিন্তা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনুভব করা যায়। তাই গ্রন্থাগার হচ্ছে কালের সাক্ষী। জ্ঞান-বিজ্ঞানসংক্রান্ত যেকোনো প্রয়োজনে লাইব্রেরি পরম বন্ধু এবং অনন্ত উৎস। পৃথিবীতে যত বড় আবিষ্কার হয়েছে, সেগুলোর প্রত্যেকের পেছনে রয়েছে লাইব্রেরির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাই অনেক বড় বড় যুদ্ধের পরে দেখা গেছে বিজয়ী শক্তি পরাজিত জাতির লাইব্রেরিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। একটি বৃহৎ লাইব্রেরি জাতির সব ধরনের তথ্যই শুধু সংরক্ষণ করে না, দেশের আসল উন্নতিতেও প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে। প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরীর 'বইপড়া' প্রবন্ধে চমৎকার একটি কথা বলেছেন- 'লাইব্রেরির সার্থকথা হাসপাতালের চাইতে কম নয় এবং স্কুল-কলেজের চাইতে একটু বেশি।' লাইব্রেরি মানুষের আনন্দেরও খোরাক জোগায় এবং মানুষের মনকে প্রশান্ত করে। পুস্তক পাঠ মানুষের একটি সৃষ্টিশীল শখ। আর এই শখ পূরণের জন্য লাইব্রেরির গুরুত্ব অবশ্যম্ভাবী। উদাহরণ হিসেবে আরও বলা যেতে পারে- সৈয়দ মুজতবা আলীর 'বইকেনা' প্রবন্ধ সম্পর্কে। ওই প্রবন্ধে বলা হয়েছে, মার্ক টুইন এত বই সংগ্রহ করেছিলেন যে বইগুলো ঘরের ছাদ পর্যন্ত ঠেস লাগত। লেখক ওই প্রবন্ধের আর এক জায়গায় বলেছেন, 'বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।' কেননা এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, 'বই পড়িলে আলোকিত মানুষ হই, না বই পড়িলে অন্ধকারে রই।'
যে জাতি যত উন্নত, সেই দেশের লাইব্রেরি তত সমৃদ্ধ। তাই আমাদের বাংলাদেশের উন্নতির জন্য আরও লাইব্রেরি তৈরি করতে হবে এবং আলোকিত মানুষ হওয়ার জন্য ভালো ভালো লেখকের বই বেশি বেশি করতে হবে এবং নিজেও গবেষণা করে বই লেখার চেষ্টা করতে হবে। তাহলেই আমাদের দেশ দিন দিন আরও জাতির সভ্যতা ও উন্নতির মানদন্ডে পৌঁছতে পারবে।
১৯. দুর্নীতি জাতির সকল উন্নতির অন্তরায়।
অথবা, দুর্নীতি জাতীয় জীবনে অভিশাপস্বরূপ।
ভাবসম্প্রসারণ : জাতি, উন্নতি, দুর্নীতি- এ ত্রয়ীর উচ্চারণের শেষান্তে মিল থাকলেও প্রথমটির জন্য দ্বিতীয়টি যতটা প্রয়োজনীয়, দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে তৃতীয়টি ততোধিক ক্ষতিকর এবং বর্জনীয়।
অসৎ বা অবৈধ সুবিধা লাভের জন্য মানুষের পরিচালিত কার্যক্রমের নামই দুর্নীতি। অন্যদিকে, উন্নতি হচ্ছে পরিকল্পিত কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে অবাঞ্ছিত অবস্থা থেকে বাঞ্ছিত অবস্থায় উত্তরণ।
সাধারণভাবে সারাবিশ্বেই এটি বিশ্বাস করা হয়, দুর্নীতি জাতীয় উন্নতির অন্তরায়। দুর্নীতি ও উন্নতির সম্পর্ক আপাত বিরোধী। একদিকে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড দুর্নীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে, অন্যদিকে ব্যাপক দুর্নীতির ফলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। দুর্নীতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায়। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে দুর্নীতি বিষয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদনে উলেস্নখ করেছে- বাংলাদেশের দুর্নীতির বা্যাপকতা রোধ করা গেলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ২-৩ শতাংশ বেড়ে যেত এবং মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হতো। দুর্নীতি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও একটি অন্যতম বাধা। অন্যদিকে, দুর্নীতি এবং দারিদ্র্য আমাদের জাতীয় জীবনের দুটি সমবর্তী সমস্যা। দারিদ্র্য অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে সহায়তা করছে, আবার দুর্নীতির ফলে আমরা দারিদ্র্যের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। সর্বোপরি স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ মানবোন্নয়নের বিভিন্ন খাতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে বরাদ্দকৃত অর্থের ৭৫ ভাগই দুর্নীতিবাজরা আত্মসাৎ করছে বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক প্রণীত রিপোর্টে দেখা যায়।
দুর্নীতি উন্নতির প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি মূর্তিমান অভিশাপ হিসেবে বিরাজ করে উন্নতির ক্ষেত্রে মারাত্মক অন্তরায় সৃষ্টি করছে। তাই যে কোনো মূল্যে সরকার ও জনগণের সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে এদেশ থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে হবে। তবেই এদেশে সোনালি ও সুখী ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হবে।
হ পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়