রোববার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

দশম শ্রেণির বাংলা দ্বিতীয় পত্র

আতাউর রহমান সায়েম সহকারী শিক্ষক মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ
  ০৮ জুন ২০২৪, ০০:০০
দশম শ্রেণির বাংলা দ্বিতীয় পত্র

১৫. পরের অনিষ্ট চিন্তা করে যেই জন, নিজের অনিষ্ট বীজ করে সে বপন।

ভাবসম্প্রসারণ : আপনার উপকার হবে ভেবে যেজন অপরের অপকারে আত্মনিয়োগ করে, পরিণামে সে নিজেই কষ্ট ভোগ করে।

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে মানুষ পরস্পর পরস্পরের সহযোগী হয়ে বসবাস করে। একে অপরের কল্যাণ সাধন করাই মানুষের মানবিক ও নৈতিক ধর্ম। পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষের পার্থক্য হলো- মানুষ শুধু নিজের কথা চিন্তা করে পৃথিবীতে বেঁচে থাকে না। মানুষকে তার চারপাশের জগৎ নিয়েও ভাবতে

হয়। যে মানুষ সর্বদা অন্যের উপকার করার কথা ভাবে এবং নিজেকে সর্বদা অন্যের হিতার্থে ব্যাপৃত রাখে, সে সমাজে সম্মানিত হয়। অন্যদিকে, মানুষ যখন নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয় তখন সে অপরের ক্ষতি সাধনে তৎপর হয়। যে মানুষ সর্বদা অন্যের ক্ষতির চিন্তায় মগ্ন থাকে, সে সর্বদা হীনম্মন্য অবস্থায় থাকে। এতে তার চিত্তে শুদ্ধি আসে না বলে সে তার স্বীয় কর্মক্ষেত্রেও উন্নতি করতে পারে না। কেননা, মানুষের স্বার্থবুদ্ধি প্রাধান্য পেলে তার পরিণতি শুভ হয়। অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নিজে লাভবান হওয়ার চেষ্টা অন্যায় কর্ম বলে বিবেচিত হয়। আর এ অন্যায় যারা করে অর্থাৎ নিজের স্বার্থকে যারা বড় করে দেখে তারা মহৎ ব্যক্তি নয়, তাদের কাছ থেকে মহৎ কিছু প্রত্যাশা করা যায় না। তারা সংকীর্ণমনা, অনুদার। তাদের কাজ-কর্মে শুধু অন্যের একার ক্ষতি হয় না; বরং সমাজ ও জাতির পাশাপাশি তার নিজেরও বিরাট ক্ষতি হয়। পার্থিব কর্মের ফল মানুষ কোনো না কোনোভাবে পৃথিবীতেই পেয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে- নাট্যনির্মাতা মমতাজ উদদীন আহমদের 'সুখী মানুষ' নাটিকায় দেখা গেছে, প্রতীকী চরিত্রে মোড়ল নিজের স্বার্থের জন্য অন্যের ক্ষতি করেছিল। ফলে তার হাড়মড়মড় রোগ হয়েছে যা কোনো চিকিৎসার মাধ্যমে তার রোগ নিরাময় হয়নি। তাই এমন ব্যক্তিরা নিজেই বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে। কবিগুরু রবিঠাকুরের ভাষায়- 'যারে তুমি নিচে ফেল, সে তোমারে বাঁধিছে যে নিচে,/ পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।'

'ঞড় বাবৎু ধপঃরড়হ :যবৎব রং ধহ বয়ঁধষ ধহফ ড়ঢ়ঢ়ড়ংরঃব ৎবধপঃরড়হ.' অর্থাৎ প্রত্যেক ক্রিয়াই একটি সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আসলেই অন্যের যেটুকু ক্ষতি করা হয় তার সমপরিমাণ ক্ষতি নিজেরও হয়ে যায়। তাই অন্যের ক্ষতি করার চিন্তার পরিবর্তে পরোপকারে আত্মনিয়োগ করাই উত্তম।

১৬. অন্যায় সে করে আর অন্যায় যে সহে,

তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে।

ভাবসম্প্রসারণ : অন্যায়কারী এবং অন্যায় সহ্যকারী উভয়েই সমান অপরাধে-অপরাধী। সময়ের ব্যবধানে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় মানুষের আচরণগত বিপরীতধর্মী দুটি দিক। কেউ কেউ ব্যক্তি বা সমাজজীবনের বৃহত্তম কল্যাণ ও সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে ভালো ও ন্যায় কাজ করে, আবার কেউ কেউ বিপরীতমুখী হয়। বস্তুত আমাদের সমাজে অন্যায়প্রবণ মানুষ সংখ্যায় কম হলেও তারা বৃহত্তর সুশীল সমাজকে জিম্মি করে রাখে। তারা অন্যকে অহেতুক উৎপীড়ন করে, অন্যের অধিকারে অন্যায় হস্তক্ষেপ করে, উচ্ছৃখল আচরণে সামাজিক শৃঙ্খলা নস্যাৎ করে। এরা সমাজের চোখে অন্যায়কারী এবং আইনের চোখে অপরাধী। এদের অপরাধ অবশ্যই দন্ডনীয়। কিন্তু মানুষ বিবেকবান হিসেবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকারী হলেও অনেক সময় নানান কারণে দিনের পর দিন অন্যায় সহ্য করে যায়। এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সৎ সাহস তাদের থাকে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের এ প্রতিবাদহীন নির্লিপ্ততা প্রকারান্তর অন্যায়কারীকে আরও বেপরোয়া করে তোলে। দিনে দিনে বাড়ে তার শক্তি-সাহস। সাধারণ মানুষ মেরুদন্ডহীনের মতো মুখ বুঁজে থাকতে বাধ্য হয়। জগতের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ বিধাতার প্রতিনিধিরূপে ন্যায়-অন্যায় মূল্যায়নের মাধ্যমে অন্যায় কাজ ও অন্যায় চিন্তা থেকে বিরত থাকবে। ক্ষমাশীলতা মানুষের

একটি মহৎ গুণ। কিন্তু ক্ষমারও একটা বিশেষ সীমা থাকা প্রয়োজন। অন্যায়কারীকে ক্ষমা করার মাঝে কোনো মহত্ত্ব নেই। নেই কোনো কৃতিত্ব যারা এদের ক্রমাগত ক্ষমা করে প্রশয় দেয় তাদের অপরাধও কম নয়। কেননা অন্যায়কারীর মতোই অন্যায়কে প্রশ্রয়দানকারী সমান অপরাধে অপরাধী। তাই মনীষী গ্যাটে বলেন, 'যখন তোমার পাশে কোনো অন্যায় অবিচার সংঘটিত হয়, তুমি যদি সেই অন্যায়ের বিরোধিতা না করো, তা হলে তুমি তোমার কর্তব্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।' হযরত মুহম্মদ (স.) কখনই অন্যায় সহ্য করেননি। তিনি কাফেরদের অন্যায়ের প্রতিরোধে পাহাড়ের মতো কঠিন হতেন। তাই তো তিনি বলেছেন- 'কারও অন্যায় করা দেখলে প্রথমে তাকে হাত দিয়ে বাধা দাও, সম্ভব না হলে তাকে মুখ দিয়ে বাধা দাও, তাও সম্ভব না হলেও তাকে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করো। তবে এটি (তৃতীয় ধাপটি) নিম্নস্তরের ইমানের পরিচয় হবে।'

অন্যায়কে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করতে হবে। ক্ষমা যেখানে দুর্বলতা সেখানে অত্যন্ত কঠিন হতে হবে।

১৭. জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।

ভাবসম্প্রসারণ : স্রষ্টার সন্তুষ্টি বিধানের অন্যতম পথ হচ্ছে তার সৃষ্ট জীবকে ভালোবাসা। জীব সেবার মাধ্যমেও মহান সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করা যায়। এ পৃথিবীর সব কিছুই নিরন্তর নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে যাচ্ছে। মানুষের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে স্রষ্টার উপাসনা করা। বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন উপায়ে স্রষ্টার উপাসনা করা যায়। তন্মধ্যে স্রষ্টাকে পাওয়ার শ্রেষ্ঠ পথ তার সৃষ্ট জীবকে ভালোবাসা। মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমে স্রষ্টাকে উপলব্ধি সহজতর হয়।

প্রত্যেক সৃষ্টির মধ্যেই আলস্নাহ বিরাজমান। এ সত্য প্রত্যেক মহাপ্রাণ মনীষী, ধর্মপ্রবর্তক, লোকহিতৈষী এক বাক্যে স্বীকার করেছেন। বিধাতা গভীর ভালোবাসার এই সুবিশাল বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেছেন। বিশ্বের সৃষ্টির মধ্যে যা কিছু রয়েছে তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করলে সৃষ্টিকর্তা মানুষের প্রতি খুশি হন। ঝ.ঞ. ঈড়ষৎরফমব-এর 'ঞযব অহপরবহঃ গধৎরহবৎ্থ গল্পে দেখা যায়, এক নাবিক জাহাজের পাটাতনে মুমূর্ষু একটা ছোটো সাপকে বাঁচানোর প্রচেষ্টার মাধ্যমে মূলত সৃষ্টিকর্তার সেবার দিকটি বোঝানো হয়েছে। জীবের প্রতি ভালোবাসার পথ ধরেই স্রষ্টাকে খোঁজ করার নির্দেশনা রয়েছে ধর্মীয়ভাবে। তাই মানুষের উচিত জীবে দয়া করা। আমাদের হযরত মুহম্মদ (সা.) তিনিও পশু-প্রাণীকে ভালোবাসতেন। শীতকালে একবার এক বিড়াল মুহম্মদ (স.)-এর চাদরে ঘুমিয়ে ছিলেন। রাসূল (স.) জরুরি প্রয়োজনে ওই জায়গা থেকে উঠতে চাইলে বিড়ালটির ঘুম না ভাঙিয়ে কেচি দিয়ে চাদর কেটেছিলেন। এরপর এক সাহাবি বিড়াল খুবই পছন্দ করতেন বলে তিনি তাকে আদর করে 'আবু হোরাইরা' বা 'বিড়ালের বাবা' বলে ডাকতেন। আবার এক খারাপ নারী তৃষ্ণার্ত এক কুকুরকে কুয়া থেকে পানি পান করানোর জন্য মহান আলস্নাহ এতই খুশি হয়েছিলেন যে ওহির মাধ্যমে রাসূল (স.) জানিয়ে দেন যে, ওই নারী জান্নাতি। হিন্দু ধর্মের ধর্মযাজক স্বামী বিবেকানন্দও বলেছেন, 'জীব সেবাই ঈশ্বর সেবা।' তাই জীব সেবা বাদ দিয়ে যদি কেউ ঈশ্বরের সেবা করতে যায়, ঈশ্বর তাতে সন্তুষ্ট হতে পারে না। মহামানবদের মুখ নিঃসৃত বাণী- মানুষকে সেবা করা, সাহচর্য দেওয়া ও ভালোবাসা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ ধর্ম। যার শুভাশীষে সৃষ্টি ধন্য, এ জগৎ পরিব্যপ্ত, জীব সেবা যে তারই সেবা।

সৃষ্টির ভেতর দিয়েই স্রষ্টার প্রকাশ। তাই তার সৃষ্ট জীবকে সেবা করলে প্রকারান্তরে তাকেই সেবা করা হয়।

হ পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে