দশম শ্রেণির বাংলা দ্বিতীয় পত্র
প্রকাশ | ০৬ জুন ২০২৪, ০০:০০
আতাউর রহমান সায়েম সহকারী শিক্ষক মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ
১২. প্রাণ থাকলেই প্রাণী হয়, কিন্তু মন না থাকলে মানুষ হয় না।
ভাবসম্প্রসারণ : প্রাণ বা আত্মা থাকলেই মানুষকে প্রকৃত মানুষ বলা যায় না। ব্যক্তিত্ব, মননশীলতা ও মনুষ্যত্বের শক্তিতেই মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়।
যার প্রাণ আছে তাকেই প্রাণী বলে। সেদিক থেকে মানুষের প্রাণ আছে বলে মানুষও এক ধরনের প্রাণী। কিন্তু অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে মানুষের বৃহৎ পার্থক্য রয়েছে। মানুষ মনসম্পন্ন প্রাণী। মানুষের মনে যে বিশেষ সত্তা রয়েছে তা এই পার্থক্যের কারণে। অন্য প্রাণীর মধ্যে এই মনের পরিচয় অনুপস্থিত। মানুষ তার মন দিয়ে সাধনা করে জীবনের বিচিত্র বিকাশ ঘটায়। মানুষ মন থেকে তার চিন্তা-ভাবনা, বুদ্ধি-বিবেক, আবেগ-অনুভূতি ইত্যাদি প্রকাশ করে এবং জীবনে সেগুলোর সুন্দর প্রতিফলন ঘটায়। মনের কার্যকলাপ থেকে সভ্যতা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে। মানুষের এ বৈশিষ্ট্যটি প্রাণিজগতের আর কারও নেই। তাই সকল প্রাণীর মধ্যে মানুষের স্থান ও মর্যাদা বেশি। এই শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য মানুষকে মননশীলতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। যে মানুষ পশুসুলভ আচরণ করে, যার মধ্যে মানবতাবোধ নেই, তাকে সত্যিকার অর্থে মানুষ বলা যায় না। এ প্রসঙ্গে জনৈক দার্শনিক বলেছেন- 'ঊাবৎু সধহ যধং ভরাব ংবহংব. ঈড়সসড়হংবহংব রং হড়হব ড়ভ :যবস. ইঁঃ রিঃযড়ঁঃ রঃ ধ সধহ :ঁৎহং রহঃড় ধ হড়হংবহংব.' অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষের পাঁচটি ইন্দ্রিয় (নাক, কান চোখ, জিহ্বা ও ত্বক) আছে। বিবেক এই ইন্দ্রিয়গুলো থেকে আলাদা। কিন্তু এটা ছাড়া একজন মানুষ পশুতে পরিণত হয়ে যায়। অর্থাৎ বিবেকহীন মানুষ হয়ে যায়। আবার প্রাবন্ধিক মোতাহের হোসেন চৌধুরী তার 'শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব' প্রবন্ধে বলেছেন- 'মানুষের মধ্যে দুটি সত্তা রয়েছে। একটি হচ্ছে জীবসত্তা, অন্যটি হচ্ছে মানবসত্তা। যার মধ্যে জীবসত্তার চেয়ে মানবসত্তার গুরুত্ব বেশি নেই,
সে প্রকৃত মানুষ না।' মানুষ কেবল প্রাণের অধিকারী হলেই হবে না, মনেরও অধিকারীও হতে হবে। যে মন অন্যকে ভালোবাসবে, সে অন্যের ভালোবাসা পাবে। তাই মানুষ হতে হলে কেবল প্রাণ থাকলেই চলবে না। শিক্ষা, সাধনা ও অনুশীলনের মাধ্যমে মানবিক গুণাবলি আয়ত্ত করে সত্যিকারের মনসম্পন্ন মানুষ হতে হবে।
১৩. নির্বাক মিত্র অপেক্ষা স্পষ্টভাষী শত্রম্ন অনেক ভালো।
অথবা, স্পষ্টভাষী শত্রম্ন নির্বাক মিত্র অপেক্ষা ভালো।
ভাবসম্প্রসারণ : যে ব্যক্তি সত্য প্রকাশ করতে সাহস পায় না, সে বন্ধু হলেও প্রকৃত বন্ধু নয়। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি সত্য কথা বলতে দ্বিধাবোধ করে না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদী, সে বন্ধু না হলেও নির্বাক বন্ধু অপেক্ষা অনেক ভালো।
মিত্রতা দুটি দেশের মধ্যে অভিন্ন এক হৃদয় সৃষ্টি করে। দৃষ্টিভঙ্গির সমতার মাধ্যমে মিত্রতা গড়ে ওঠে। একজন সৎ বন্ধু প্রত্যেকের জীবনে অপরিহার্য। কিন্তু কোনো ব্যক্তি যদি তার বন্ধুর বিপদে নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করে, তাহলে এমন বন্ধু থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে- ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনে পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফর স্বার্থপরতার কারণে বাঙালি হয়েও স্বদেশপ্রেম উপেক্ষা করে নবাব সিরাজুদ্দৌলার সঙ্গে বেইমানি করে ইংরেজদের পক্ষে আঁতাত করেছিল। সে সেনাপ্রধান হয়েও নবাবের পক্ষে যুদ্ধ করেনি; বরং নির্বাক থেকে মুনাফিকি আচরণ করেছে। অন্যদিকে, মানুষের জীবনের এক মহৎ গুণ স্পষ্টবাদিতা। স্পষ্টভাষী লোক শত্রম্ন হলেও নির্বাক বন্ধু অপেক্ষা সহস্র গুণ শ্রেয়। এ প্রসঙ্গে সংস্কৃতে একটি প্রবাদ আছে, যার বাংলা অর্থ- যিনি সামনে প্রিয় বাক্য বলেন, কিন্তু পরোক্ষ ক্ষতি করেন, তিনি বন্ধু হলেও উপরে দুধ আর ভিতরে বিষ রাখা দুধের কলসির মতো। আমাদের সমাজে এমন অনেক লোক আছেন যারা বন্ধুর বিপদে বন্ধুর পাশে থেকেও কোনো প্রকার সাহায্য বা সহানুভূতি প্রকাশ না করে নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। তারা সযত্নে সব ধরনের ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে চান। অন্যায়কে অন্যায় বলার মতো সৎ সাহসও তাদের থাকে না। এমন প্রকৃতির ব্যক্তি বন্ধু হলেও তাকে পরিত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়। অন্যদিকে স্পষ্টবাদী ব্যক্তি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদী। তার সম্মুখে ঘটে যাওয়া অন্যায়কে সে অন্যায় বলে প্রতিবাদ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। একজন ব্যক্তি তার দোষ-ত্রম্নটি সম্পর্কে অবহিত হতে পারে এবং তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। তাই স্পষ্টভাষী ব্যক্তি শত্রম্ন হলেও নির্বাক বন্ধু অপেক্ষা অনেক ভালো। সে শত্রম্ন হলেও স্পষ্টবাদিতার গুণে মহৎ বন্ধু। হযরত ওমর (রা.)-এর ভাষায়- 'যে তোমার দোষ ধরে, বন্ধু সেই জন।' বন্ধুকে ভুল পথে চলতে দেখে যে বন্ধু নীরব সম্মতি জ্ঞাপন করে, সে কখনো বন্ধু নয়। বরং যে দোষ-ত্রম্নটি ধরে সঠিক পথে চলার দিকনির্দেশনা দেয়, সে শত্রম্ন হলেও নির্বাক বন্ধু অপেক্ষা ভালো।
১৪. সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা, আশা তার একমাত্র ভেলা।
ভাবসম্প্রসারণ : এ সংসার সমুদ্রে মানুষের জীবন প্রতিনিয়ত দুঃখ-দৈন্যে আবর্তিত হচ্ছে। এর মাঝে আশাই তাকে টিকিয়ে রেখেছে। আশা না থাকলে তার জীবন হয়ে পড়ত স্থবির।
একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নিয়েই মানুষ এ পৃথিবীতে আসে। কখন তার এ নির্দিষ্ট সময় ফুরিয়ে যাবে, তা সে জানে না। তবু আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই, শেষ নেই জাগতিক নানান সুখ-স্বপ্নের। প্রতিনিয়ত স্বপ্নময় পরিকল্পনায় আমরা চাই সুখ, শান্তি, সম্পদ, সাফল্য। কিন্তু চাইলেই কি সব পাওয়া যায়? জীবনে দুঃখ আছে, দৈন্য আছে, আছে আশা ভঙ্গের হতাশা, আছে নিরবচ্ছিন্ন সুখ ভোগে নানান প্রতিবন্ধকতা।
জীবনে প্রতিনিয়ত, শান্তির সঙ্গে অশান্তির, সুখের সঙ্গে দুঃখের, সার্থকতার সঙ্গে ব্যর্থতার নিরন্তর দ্বন্দ্ব চলছে। তথাপি মানুষকে এসব বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হয়। তার আশা, একদিন জীবনে
সুখময় ও আনন্দময় হয়ে উঠবে। বিক্ষুব্ধ সাগর পাড়ি দেওয়ার জন্য যেমন প্রয়োজন হয় জাহাজের, সংসার সাগরেও তেমনি সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কোনো অবলম্বন দরকার। সংসারের এ অবলম্বন হচ্ছে মানুষের মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা। বর্তমানের ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে জীবন তার মধ্যে প্রেরণা জোগায় ভবিষ্যতের আশা। আজকের জীবনের সংকট আর সমস্যা আগামী দিনে থাকবে না, এ আশা নিয়ে মানুষ সংসার-সাগর পাড়ি দেয়। বর্তমানের বাস্তবতার চেয়ে ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন মানুষকে অধিক উদ্দীপ্ত করে। একদিন আঁধার কেটে সুদিন আসবে- এ আশায় মানুষ বর্তমানের গস্নানি উপেক্ষা করার চেষ্টা করে।
আশা মানুষের জীবনীশক্তির সঞ্চার করে। আশা না থাকলে মানুষ ডুবে যেত দুঃখের অতল গর্ভে।
আশাই মানুষকে এনে দেয় সুখের আশ্বাস, দেয় দুঃখ সাগর পাড়ি দেওয়ার দুরন্ত সাহস। আর তাই তো ইংরেজিতে একটি কথা আছে- 'ডযবৎব :যবৎব রং ষরভব, :যবৎব রং যড়ঢ়ব.্থ অর্থাৎ 'যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ'। সংসার জীবনে সুখের চেয়ে দুঃখই বেশি। তথাপি সোনালি দিনের আশা নিয়ে মানুষ এ দুঃখময় সংসারে বেঁচে থাকে।
হ পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়