দশম শ্রেণির বাংলা দ্বিতীয় পত্র

প্রকাশ | ০৩ জুন ২০২৪, ০০:০০

আতাউর রহমান সায়েম সহকারী শিক্ষক মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ
৫. স্বদেশের উপকারে নাই যার মন, কে বলে মানুষ তারে? পশু সেই জন। ভাবসম্প্রসারণ : স্বদেশপ্রেম মানুষের একটি মহৎ গুণ। স্বদেশ ও স্বজাতির উপকার সাধন মানুষের অন্যতম কর্তব্য। কিন্তু যার মধ্যে স্বদেশপ্রীতি নেই, সে মানুষ হলেও পশুতুল্য। দেশপ্রেম মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি। এটি মানুষের চরম ও পরম সম্পদ। দেশপ্রেম ছাড়া মানুষের মধ্যে মা, মাটি এবং মানুষকে ভালোবাসার মতো মহৎ মানবিক চেতনা সৃষ্টি হয় না। তাই মনীষীকুল জন্মভূমিকে মায়ের মতো বলে বর্ণনা করেছেন। মায়ের রক্ত, মাংস, অস্থি, মজ্জা যেমন সন্তানের অণু-পরমাণুর সঙ্গে মিশে থাকে, তেমনি মিশে থাকে জন্মভূমির আলো, বাতাস, রূপ, রস, গন্ধ তাদের আপাদমস্তকে। সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) দেশপ্রেম সম্পর্কে বলেছেন, 'স্বদেশপ্রেম ইমানের অংশ'। স্বদেশের প্রতি গভীর ভালোবাসার পরিচয় ফুটে উঠেছে কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস রচিত 'জন্মভূমি' কবিতার প্রতিটি ছত্রে- 'জননী গো জন্মভূমি তোমারি পবন / দিতেছে জীবন মোরে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে।' যারা দেশকে ভালোবাসেন এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন, প্রকৃতপক্ষে তারাই মানুষ নামের যোগ্য। জগতের মহামানবদের প্রত্যেকেই ছিলেন স্বদেশভক্ত ও দেশের উপকারে নিবেদিত প্রাণ। বীরপুরুষরা দেশের জন্য প্রাণ দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। তারা দেশের জন্য অকাতরে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে থাকেন। এরূপ ইচ্ছে যে ব্যক্তির নেই, সে মানুষ হিসেবে অযোগ্য। নিজ মাতৃভূমিকে যে ভালোবাসে না, স্বদেশের জন্য যার কোনো অবদান নেই, মানুষ নামের জীব হয়েও সে বিবেক-বুদ্ধিহীন পশুতুল্য। সমাজের চোখে সে ঘৃণার পাত্র। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে- ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনে পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফর স্বার্থপরতার কারণে বাঙালি হয়েও স্বদেশপ্রেম উপেক্ষা করে নবাব সিরাজুদ্দৌলার সঙ্গে বেইমানি করে ইংরেজদের পক্ষে আঁতাত করেছিলেন। ফলে আজও কোনো বাঙালি তাকে শ্রদ্ধা করে না; বরং ঘৃণা করে। আবার মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম তার 'বঙ্গবাণী' কবিতায় মাতৃভাষা বাংলা বিদ্বেষীদের কটাক্ষভাবে ব্যঙ্গ করেছেন। তিনি তাদের এ জন্মভূমি ছেড়ে অন্যত্রে চলে যেতে বলেছেন। দেশপ্রেম মানবজীবনের একটি শ্রেষ্ঠ গুণ ও অমূল্য সম্পদ। দেশমাতৃকার কল্যাণে যিনি আত্মোৎসর্গ করেন, তিনিই প্রকৃত মানুষ। পক্ষান্তরে দেশের ভালোবাসায় যার মন নেই, সে পশুতুল্য। ৬. নানান দেশের নানান ভাষা বিনা স্বদেশী ভাষা, মিটে কি আশা? ভাবসম্প্রসারণ : মাতৃভাষার সুধা মাতৃতুল্য। মাতৃভাষার মাধ্যমে যত সহজে মনের ভাব প্রকাশ করা যায়, অন্য ভাষায় তা সম্ভব নয়। মাতৃভাষার মাধ্যমেই মানুষ প্রকৃত রসাস্বাদন করতে পারে এবং এই ভাষায়ই তাদের প্রাণের স্ফূর্তি ঘটে। পৃথিবীর প্রায় সব জাতিরই নিজস্ব ভাষা আছে এবং এক ভাষা থেকে অন্য ভাষা আলাদা। আমরা ভাষার মাধ্যমে শুধু নিজের মনের ভাবই অন্যের কাছে প্রকাশ করি না, মাতৃভাষার সাহায্যে অন্যের মনের কথা, সাহিত্য-শিল্পের বক্তব্যও নিজের মধ্যে অনুভব করি। নিজের ভাষায় অনেক কিছু বোঝা যত সহজ, অন্য ভাষায় তা সম্ভব নয়। বিদেশে গেলে নিজের ভাষার গুরুত্ব অনুভব করা যায় আরও প্রখরভাবে। তখন নিজের ভাষাভাষী মানুষের জন্য ভেতরে ভেতরে মরুভূমির মতো তৃষিত হয়ে থাকে মানুষ। আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের ভাষা। বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলি, পড়ালেখা করি, গান গাই, ছবি আঁকি, সাহিত্য রচনা করি, হাসি, খেলি, আনন্দ-বেদনা প্রকাশ করি। অন্য ভাষায় তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে করা সম্ভব নয়। এজন্যই হয়তো মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম তার 'বঙ্গবাণী' কবিতায় লিখেছেন- 'মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি/ দেশি ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।' মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনের শুরুতে অন্য ভাষায় সাহিত্য রচনা করে পরে অনুতপ্ত হয়েছেন এবং পরবর্তীকালে মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছেন। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ এই ভাষায় সাহিত্য রচনা করে যশস্বী হয়েছেন। সুপেয় জল যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি স্বদেশের ভাষা সুমিষ্ট। মাতৃভাষার গুরুত্ব বুঝতে পেরেই ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে আমাদের দামাল ছেলেরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য নিজের জীবনকেও বিসর্জন দিয়েছেন। মায়ের মুখের বুলি থেকে শিশু তার নিজের ভাষা আয়ত্ত করা শুরু করে এবং এই ভাষাতেই তার স্বপ্নগুলো রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে। এই ভাষাতেই লেখাপড়া করে এবং জগৎ ও জীবনকে চিনতে শুরু করে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, 'শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ স্বরূপ।' মাতৃদুগ্ধ শিশুর পক্ষে যেমন পুষ্টিকর, বিদ্যাশিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষা তেমন সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। মাতৃভাষা পুরোপুরি শেখার পর ভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের জন্য, দেশ-বিদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত রাখার জন্য আমাদের অন্য ভাষা বিশেষ করে ইংরেজি ভাষা শিখতে হয়। কিন্তু মাতৃভাষার বুনিয়াদ শক্ত না হলে অন্য ভাষা শেখাও আমাদের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে। এজন্যই হয়তো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, 'আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন।' স্বদেশের ভাষাকে ভালোবাসতে হবে, এর বিকাশ ও সমৃদ্ধিকে অবাধ করতে হবে এবং বিকৃতিকে রোধ করতে হবে। তাহলেই আমরা বিশ্বের অন্যান্য জাতি থেকে ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে আরও পরিচিতি লাভ করতে পারব। পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়