ইতিহাস ও ঐতিহ্য

বাকিংহাম প্যালেস

প্রকাশ | ০২ জুন ২০২৪, ০০:০০

শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার শহরের 'বাকিংহাম প্যালেস' ব্রিটেনের রাজতন্ত্র ও রাজকীয় আভিজাত্যের প্রতীক। যুক্তরাজ্যের রাজপরিবার তথা রাজার বাসভবন বাকিংহাম প্যালেস, বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত, অন্যতম বিলাসবহুল এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি ভবন। ব্রিটেনের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ রাষ্ট্রীয় এবং রাজকীয় অনুষ্ঠানগুলো এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। পাশেই অবস্থিত 'বাকিংহাম প্যালেস গার্ডেন' লন্ডনের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিগত বাগান। যুক্তরাজ্যের যেকোনো জাতীয় আনন্দোৎসব এবং বিপরীতক্রমে সংকটময় পরিস্থিতিতে মানুষের সমাবেশস্থলে পরিণত হয় এই বাকিংহাম প্যালেস। পৃথিবীতে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা স্থাপনাগুলোর মধ্যে এই রাজপ্রাসাদ অন্যতম। মধ্যাহ্নভোজ ও নৈশভোজ ছাড়াও বিভিন্ন অভ্যর্থনাকেন্দ্রিক ভোজন অনুষ্ঠান এবং রয়াল গার্ডেন পার্টিতে শুধু অতিথি হিসেবেই প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজারের অধিক মানুষ বাকিংহাম প্যালেস ঘুরে যায়। ১৫৩১ সালে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবেতে সেন্ট জেমস হাসপাতাল ও ইটন কলেজ ক্রয় করেন। ৪ বছর পর 'ম্যানর অব ইবুরি' এর মালিক হন। আর এতে করেই ঐতিহাসিক বাকিংহাম প্যালেসের স্থানটি আবার ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের মালিকানাধীন হয় যা প্রায় ৫০০ বছর আগে অর্থাভাবে 'উইলিয়াম দ্য কনকারার' বিক্রয় করে দিয়েছিলেন। বাকিংহাম প্যালেসের আদি ভবনটি বাকিংহাম হাউজ নামে পরিচিত। ১৭০৩ সালে এই ভবনটি ডিউকের দরবার হল হিসেবে নির্মিত হয়। ১৭৬২ সালে এই ভবনটি আয়ত্তে আনেন রাজা তৃতীয় জর্জ। তিনি এর পরিবর্ধনের কাজ শুরু করেন এবং নাম পরিবর্তন করে 'দ্য কুইন'স হাউজ' রাখেন। ১৮৩৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে 'বাকিংহাম হাউজ' ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের বাসভবন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। রানী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনে আরোহণের মাধ্যমেই বাকিংহাম প্যালেসের পরিচয় চিরতরে বদলে যায়। তবে নতুন প্রাসাদে উঠেই রানী দেখেন যে রাজপরিবারের রাজকীয় মানদন্ডের সঙ্গে প্রাসাদটি মানানসই না। দ্রম্নতই নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে থাকে। রানী একটি নতুন প্রাসাদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকেন। ১৮৪০ সালে তিনি প্রিন্স আলবার্টের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং একই সাথে বাকিংহাম প্যালেসে সাময়িকভাবে সংস্কার কাজ করেন। সংস্কার করার পর রানী ভিক্টোরিয়া ও তার স্বামী আলবার্ট অনুভব করলেন প্রাসাদটি রাজদরবার হিসেবে ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট বড় নয়। তখনই অ্যাডওয়ার্ড বেস্নার এর নতুন একটি অংশ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এই অংশটিই মূলত বাকিংহাম প্যালেসের সবচেয়ে পরিচিত অংশ। কারণ এই অংশটি 'দ্য মল' এর দিকে মুখ করে তৈরি করা হয়েছে এবং এখানে রয়েছে বিখ্যাত সেই 'ব্যালকনি' বা ঝুল বারান্দা যেখানে দাঁড়িয়ে রানী সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ান। বাকিংহাম প্যালেসের আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ হলো এর 'রয়্যাল মিউজ' বা রাজকীয় পরিবহণ রাখার স্থান, যেখানে রয়েছে বিশাল অশ্বশালা বা আস্তাবল। এই স্থানটি বছরের অধিকাংশ সময়ই দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। সারি করে রাখা রাজকীয় পরিবহণ, স্টেট ও সেমি স্টেট কার এবং ৩০টি ঘোড়া এই রয়াল মিউজের শোভা বর্ধন করে। বাকিংহাম প্যালেসের আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে 'দ্য মল'। এটি হচ্ছে একটি সংযোগ রাস্তা যা ট্রাফালগার স্কয়ার এবং বাকিংহাম প্যালেসকে সংযুক্ত করেছে। যেকোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে এবং সরকারি ছুটির দিনগুলোতে দর্শনার্থীদের সুবিধা করে দিতে যান চলাচল বন্ধ থাকে এই রাস্তায়। 'অ্যাডমিরালটি আর্চের' ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া এই রাস্তাটি তৈরি করা হয়েছিল রানী ভিক্টোরিয়ার 'গ্র্যান্ড মেমোরিয়াল'-এর একটি অংশ হিসেবে। দ্য মলের কাজ শেষ হয় ১৯১১ সালে। স্থপতি স্যার অ্যাসটন ওয়েব এর নকশা প্রণয়ন করেন। ৮,২৮,৮১৮ স্কয়ার ফুটের বাকিংহাম প্যালেস পৃথিবীর ১৩তম বৃহত্তম রাজপ্রাসাদ। প্রাসাদে মোট ১৯টি স্টেট রুম, ৫২টি প্রধান শয়নকক্ষ, ১৮৮টি কর্মচারীদের শয়নকক্ষ, ৯২টি অফিস এবং ৭৮টি শৌচাগার রয়েছে। ১৯০১ সালে রাজা ষষ্ঠ অ্যাডওয়ার্ড ক্ষমতায় আসলে বাকিংহাম প্যালেসের আসল সংস্কার শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বাকিংহাম প্যালেসের খুব একটা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এ সময় প্রাসাদের সব দামি ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র উইন্ডসর দুর্গে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাকিংহাম প্যালেসের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন হয়। বাকিংহাম প্যালেস ধ্বংস করতে পারলে ব্রিটিশরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে, এমন ধারণা থেকে নাৎসি বাহিনী এক-দুবার নয়, বরং সাতবার এই প্রাসাদে বোমা ছুড়েছিল। এর মধ্যে একবার তো রাজা ষষ্ঠ জর্জ এবং রানী এলিজাবেথ প্রাসাদে অবস্থানকালীন বাকিংহাম প্যালেসে নাৎসিদের বোমা আঘাত করে। তবে সৌভাগ্যক্রমে রাজা ও রানী অক্ষত ছিলেন। যুদ্ধের পর বাকিংহাম প্যালেসেই লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে বিজয় উদযাপন করেন রাজা জর্জ ও রানী এলিজাবেথ। বাকিংহাম প্যালেস ইংল্যান্ডের রাজপরিবারের নিজস্ব সম্পত্তি নয় বরং ইংল্যান্ডের জাতীয় সম্পত্তি। সবকিছু মিলিয়ে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রতীক বাকিংহাম প্যালেস পুরোটাই একটি আর্ট গ্যালারি। এর প্রতিটি কোনে থাকা দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী ও রাজকীয় আভিজাত্যের নিদর্শন একে করেছে পৃথিবীর অন্যতম সেরা দর্শনার্থী আকর্ষণ হিসেবে।