মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ কার্তিক ১৪৩১
ইতিহাস ও ঐতিহ্য

রোমাঞ্চকর অনুভূতি এনে দেয় যে দুটি কামান

শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
  ২১ মে ২০২৪, ০০:০০
রোমাঞ্চকর অনুভূতি এনে দেয় যে দুটি কামান

একসময় ঢাকার পর্যটকদের আকর্ষণ ছিল মোগল যুগের একটি কামান। ১৭৭৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে এসেছিলেন রবার্ট লিন্ডস। তিনি লিখেছিলেন, 'ঢাকায় গর্ব করার মতো তেমন কিছু নেই। লালবাগ দূর্গ, বড় কাটরা, তাঁতিবাজার আর টঙ্গীর পুল কিছুই তাকে আকৃষ্ট করেনি। শুধু একটি জিনিসই করেছে। তা হলো, ঢাকার একটি কামান।'

কোথা থেকে এলো এই কামান

এত বিশাল ও ওজনে ভারী জিনিস জলপথে হাজার মাইল দূর থেকে আনা প্রায় অসম্ভব। ১৭ শতকের গোড়ার দিকে মোগল বাদশাহ সম্রাট জাহাঙ্গীর ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থাপন করলে, এখানে গড়ে ওঠে নানা প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। সে সঙ্গে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে জলদসু্যদের উপদ্রবও। বিভিন্ন বই-পুস্তকে সেসময়কার জলদসু্যদের কথা উঠে এসেছে।

কামান দুটির একটির নাম কালে খাঁ জমজম ও অপরটির নাম বিবি মরিয়ম। ধারণা করা হয়, কালে খাঁ নামক কোনো বীর এবং তার স্ত্রীর নামে এই নামকরণ করা হয়েছিল। তবে কেউ কেউ দাবি করেছে, মীর জুমলাই এই কামান দুটির নাম রেখেছেন।

ব্রিটিশ রাজকর্মচারী ও পর্যটকেরা কালে খাঁ'কে দেখেই সবচেয়ে বেশি অবাক হতেন এবং এর বৃত্তান্ত লিখে রেখে যান। বিখ্যাত ভূগোলবিদ জেমস রেনেল তার স্মৃতিকথায় ঢাকার ঐ কামানের কথাই বিস্তারিতভাবে লিখে গেছেন। পরিমাপের দিক থেকে কালে খাঁ জমজমকে তিনি তুলনামূলক বেশি জমকালো এবং বিশাল হিসেবে আখ্যায়িত করে গেছেন।

নদী থেকে শোনা যেত গর্জন!

মীর জুমলা আসাম যুদ্ধে এই দুটি কামান ব্যবহার করেছিলেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৬০ সালে মীর জুমলাকে বাংলার সুবেদার নিয়োগ করেন। মীর জুমলা ১৬৬১ সালে আসাম অভিযানের সময় ৬৭৫টি ভারী কামান ব্যবহার করেন। তার মধ্যে বিবি মরিয়ম ছিল সর্ববৃহৎ। যুদ্ধ শেষে বিজয়ী হয়ে তিনি বিবি মরিয়মকে বড় কাটরার দক্ষিণে সোয়ারীঘাটে স্থাপন করেন। মীর জুমলার সময় বড় কাটরা ছিল ঢাকার বৈশিষ্ট্যময় একমাত্র জাঁকালো অট্টালিকা!

সৈয়দ মোহাম্মদ তাইফুর তার 'গিস্নম্পস অব ঢাকা' বইয়ে বলেন, সুবাদার মীর জুমলা কামানটিকে আসাম অভিযানের সময় ব্যবহার করেছিলেন এবং তারপর তা আবার ফিরিয়ে এনেছিলেন ঢাকায়। হতে পারে, আসাম অভিযানের পর তিনি এটিকে কাটরার সামনে স্থাপন করেছিলেন যুদ্ধ জয়ের স্মারক বা দ্রষ্টব্য হিসেবে। তখন থেকে কামানটি 'মীর জুমলার কামান' নামে পরিচিত লাভ করে। বুড়িগঙ্গার মোগরাই চরে রাখা হয় কালে খাঁ জমজমকে। পরবর্তীতে নদীভাঙনে বুড়িগঙ্গায় বিসর্জিত হয় কালে খাঁ জমজম।

রবার্ট লিন্ডস ১৭৮০ সালের নদীভাঙনে কালে খাঁ জমজমের ক্ষতির জন্য কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করে গেছেন। কিন্তু স্থানীয়দের কাছে তা এতটাই পূজনীয় ও আধ্যাত্মিক ছিল যে তারা মনে করতেন, স্বর্গ থেকে এটি এসেছিল, আবার স্বর্গেই তা ফিরে গেছে!

এমনকি তাদের এই কুসংস্কারের তীব্রতা বোঝা যায় নিচের ঘটনাটি পড়লে। মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, বুড়িগঙ্গায় কালে খাঁ জমজম ডুবে যাওয়ার পর লোকমুখে কুসংস্কার বেরিয়েছিল যে, নদী থেকে বিবি মরিয়মের (পরবর্তীতে মীর জুমলা নামকরণ) জন্য বুড়িগঙ্গা থেকে প্রায়ই গর্জন ভেসে আসত। তারা বিশ্বাস করতেন, এ গর্জনের অর্থ হলো, 'কালে খাঁ' তার সঙ্গিনী 'মরিয়ম'কে ডাকছে। এবং তারা হলফ করে বলতেন, যে ঐ গুরুগম্ভীর আওয়াজ তারা শুনেছেন!

এত বছরেও মরিচা ধরেনি কামানে। কালে খাঁ জমজম ও বিবি মরিয়মের নকশা তৈরি এবং নির্মাণকাজ তদারকি করেন মোগল কামান নির্মাতারা। এ কামান দুটি প্রমাণ করে তখনকার ঢাকার কামান তৈরির কারিগরদের দক্ষতা। মোগল আমলে ঢাকায় উন্নতমানের কামান তৈরির বহু কারিগর ছিলেন। তখন ঢাকায় এ কামান শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। মজবুত ও টেকসই কামান তৈরিতে তারা ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সুবেদার ও জমিদারেরা ফরমায়েশ দিয়ে এসব কারিগর দিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় কামান তৈরি করিয়ে নিতেন। বর্তমানে মুর্শিদাবাদে যে বিশাল কামানটি দেখা যায়, নবাব আলীবর্দী খান ঢাকায় কামান তৈরির কারিগর জনার্ধন কর্মকারকে দিয়ে তা তৈরি করিয়ে নেন।

কালে খাঁ জমজম আর বিবি মরিয়ম যেন অবিচ্ছেদ্য দুটি নাম। 'কালে খাঁ' তো নেই। বিবি মরিয়ম থেকেও মানুষের মাঝে নেই। দেশবাসী তো বটেই, ঢাকাবাসীও কামানটিকে আজ ভুলতে বসেছে। কিন্তু পুরোনো মানুষের কাছে 'মরিয়ম' আর 'কালে খাঁ জমজম' হলো দুই সঙ্গীর নাম, যাদের সাথে জড়িত ছিল তাদের জীবন, বিশ্বাস। ছিল ভয়, ভক্তি আর রোমাঞ্চের এক সেতু...।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে