ইতিহাস ও ঐতিহ্য

মহেঞ্জোদাড়ো

প্রকাশ | ১৬ মে ২০২৪, ০০:০০

শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
মহেঞ্জোদাড়ো ছিল প্রাচীন ভারতের সিন্ধু সভ্যতার বৃহত্তম নগর-বসতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি পাকিস্তান রাষ্ট্রের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় অবস্থিত। ২৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে নির্মিত এই শহরটি ছিল বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলোর অন্যতম। প্রাচীন মিসর, মেসোপটেমিয়া ও ক্রিটের সভ্যতার সমসাময়িক এই শহরটি। এই শহরের পুরাতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অংশ। এটিকে 'একটি প্রাচীন সিন্ধু মহানগর' নামেও অভিহিত করা হয়। এটি প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার বৃহত্তম শহরগুলোর একটি, যেখানে আরেকটি প্রাগৈতিহাসিক শহর হরপ্পা গড়ে উঠেছিল। সিন্ধু সভ্যতা বর্তমান পাকিস্তান ও উত্তর ভারতে ছিল। যার বিস্তৃতি ছিল ইরান সীমান্ত, দক্ষিণে ভারতের গুজরাট, উত্তরে বাক্ট্রিয়া পর্যন্ত। যার প্রধান প্রধান শহর ছিল হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো, লোথাল, কালিবাঙ্গান, ধলাবিরা এবং রাখিগাড়ি। এদের মধ্যে মহেঞ্জোদাড়ো ঐ সময়ে পুরকৌশল ও নগর পরিকল্পনায় শ্রেষ্ঠ ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ১৯ শতাব্দীতে সিন্ধু সভ্যতার প্রায় আকস্মিক পতন ঘটে এবং মহেঞ্জোদাড়ো পরিত্যক্ত হয়। মহেঞ্জোদাড়ো ছিল সিন্ধু সভ্যতার একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র। মহেঞ্জোদাড়ো ছিল দক্ষিণ এশিয়ার উন্নততম নগরী। এই শহরের নগর পরিকল্পনা ও উন্নত প্রকৌশলব্যবস্থাই প্রমাণ করে যে, সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের কাছে এই শহর ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ। এই শহরের গণভবনগুলো উচ্চমানের সামাজিক সংগঠনের পরিচায়ক। মহেঞ্জোদাড়োর মহাশস্যাগারটিতে গ্রামাঞ্চল থেকে গরুর গাড়িতে শস্য এনে জমা রাখা হতো। শস্য শুকিয়ে রাখারও ব্যবস্থা ছিল এখানে। সেখানকার মানুষ ফ্ল্যাশযুক্ত টয়লেট ব্যবহার করত। আর তাদের পানি সরবরাহ ও আবর্জনা নিষ্কাশনের এমন চমৎকার ব্যবস্থা ছিল, যা আধুনিক পাকিস্তানের অনেক শহরের চেয়ে উন্নত। ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এই শহর পরিত্যক্ত হয়। ১৯২২ সালে ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহেঞ্জোদাড়ো পুনরাবিষ্কার করেন। ১৯৩০-এর দশকে স্যার জন মার্শাল, কে. এন. দীক্ষিত, আর্নেস্ট ম্যাককি ও অন্যদের অধীনে এখানে ব্যাপক খননকার্য চালানো হয়। ১৯৪৫ সালে আহমদ হাসান দানি ও মর্টিমার হুইলারও এখানে খননকার্য চালান। মহেঞ্জোদাড়োয় শেষ বড় খননকার্য চলে ১৯৬৪-৬৫ সালে ড. জি. এফ. ডেলসের অধীনে। এরপর উন্মুক্ত স্থাপনাগুলো আবহাওয়াজনিত ক্ষয়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেখে এখানে খননকার্য নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এর পর থেকে এখানে কেবলমাত্র রক্ষণমূলক খননকার্য, উপরিতল সমীক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পেরই অনুমোদন দেওয়া হতো। ১৯৮০-এর দশকে ড. মাইকেল জ্যানসেন ও ড. মরিজিও তোসির নেতৃত্বে যৌথভাবে জার্মান-ইতালীয় সমীক্ষা দল আর্কিটেকচারাল ডকুমেন্টেশন, উপরিতল সমীক্ষা, সারফেস স্ক্র্যাপিং ও প্রোবিংয়ের উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে প্রাচীন সভ্যতার বেশ কিছু সূত্র আবিষ্কার করেন। খননে অনেক বস্তু পাওয়া গেছে। যেমন- বসা ও দাঁড়ানো মূর্তি, তামা ও পাথর সরঞ্জাম, উৎকীর্ণ করুক, দাঁড়িপালস্না এবং ওজন, স্বর্ণ ও জ্যাসপার গয়না এবং শিশুদের খেলনা। এখানে প্রাপ্ত অনেক প্রত্নতত্ত্ব ভারত ও পাকিস্তানের জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষণ করা আছে। ১৯৩৯ সালে, খননে প্রাপ্ত শিল্পকর্মের নমুনা সংগ্রহ করে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ মহাপরিচালক ব্রিটিশ মিউজিয়ামে স্থানান্তর করে। মহেঞ্জোদাড়োয় আবিষ্কৃত সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ স্থাপনা হলো মহাস্নানাগার। মহেঞ্জোদাড়োর সুরক্ষিত উত্তরাংশের পশ্চিমভাগের স্তূপের মধ্যে এটি পাওয়া গিয়েছে। উলেস্নখ্য, এই স্তূপটি 'মৃতের স্তূপ' বা 'দুর্গ' নামেও পরিচিত। পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা যায়, স্তূপটি নির্মাণের অব্যবহিত পরেই এই স্নানাগারটি। সভ্যতার শেষ ভাগের শেষ পর্বে এই স্নানাগারটি ব্যবহারোনুপযোগী হয়ে পড়েছিল। ১৯২৫-২৬ সালে এই স্নানাগারটি আবিষ্কৃত হয়। মহাস্নানাগারের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ১১.৮৮ মিটার ও ৭.০১ মিটার। এর সর্বোচ্চ গভীরতা ২.৪৩ মিটার। উত্তরে ও দক্ষিণে দুটি চওড়া সিঁড়ির মাধ্যমে স্নানাগারে প্রবেশ করা যেত। মহাস্নানাগার নির্মিত হয়েছিল উন্নতমানের পোড়া ইট দিয়ে। বিটুমেনের সারি (যা সম্ভবত জল বেরিয়ে যাওয়া রোধ করত) থেকে অনুমিত হয় এটি জল ধরে রাখার জন্য ব্যবহৃত হতো। কোনো কোনো গবেষক এই স্নানাগারকে প্রথাগত স্নান বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানস্থল বলেছেন। তবে এই স্নানাগার নির্মাণের প্রকৃত উদ্দেশ্য আজও অজ্ঞাত। ১৯৯৬ সালে যখন পাকিস্তান সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা সাহায্য বন্ধ করে দেয়, তখন মহেঞ্জোদাড়োর সংরক্ষণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তহবিলের ব্যবস্থা করে ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে এপ্রিলে পুনরায় সংরক্ষণের কাজ শুরু করে। বন্যা তহবিল থেকে অর্থের সংস্থান করে ২০ বছর মেয়াদে $১০ মিলিয়ন দেওয়া হয় অঞ্চল এবং স্থায়ী কাঠামো রক্ষার জন্য। ২০১১ সালে, সাইটের সংরক্ষণের দায়িত্ব সিন্ধু সরকারকে দেওয়া হয়। বর্তমানে ভূগর্ভস্থ লবণাক্ততা এবং ভ্রান্ত পুনর্র্নির্মাণ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক দেয়াল ইতোমধ্যে ভেঙে গেছে এবং অন্যান্য দেয়াল ক্ষয়ে গেছে। ২০১২ সালে পাকিস্তানের প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই বলে সতর্ক করেন যে, উন্নত সংরক্ষণব্যবস্থা ছাড়া এলাকাটি ২০৩০ সালের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে।