দ্বাদশ শ্রেণির সমাজকর্ম (দ্বিতীয় পত্র)

প্রকাশ | ১৪ মে ২০২৪, ০০:০০

মনিরুল হক রনি, প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ, সাভার সরকারি কলেজ, সাভার, ঢাকা
গ. উদ্দীপকে উলিস্নখিত পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার মূল কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন। বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন স্থানে ঘন ঘন সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হচ্ছে। সেই সাথে প্রকট হচ্ছে পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা; যার ইঙ্গিত উদ্দীপকে পাওয়া যায়। বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হলো পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি। তবে পৃথিবীব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো গ্রিনহাউস ইফেক্ট ও বিগত দুইশ বছরের প্রসারমান শিল্পের উন্নয়ন। পৃথিবীর জলবায়ু সূর্য থেকে পাওয়া শক্তির ওপর নির্ভর করে। আর পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের গ্রিনহাউস গ্যাস। যেমন- কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি। কিন্তু কলকারখানা ও যানবাহনের কালো ধোঁয়ার কারণে লাগামহীনভাবে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ বাড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে জলবায়ুর ওপর। এছাড়া বনাঞ্চল ধ্বংস এবং জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের জন্য বিগত কয়েক শতাব্দীতে বাতাসে কার্বন ডাই- অক্সাইডের ঘনত্ব শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বনাঞ্চল ধ্বংসের প্রভাবে সবুজ উদ্ভিদ হ্রাস পাওয়ায় সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে এ গ্যাস শোষণের মাত্রাও কমে যাচ্ছে। যার ফলে বাতাসে এর ঘনত্ব বৃদ্ধির সাথে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে তাপের বৃদ্ধি ঘটছে। বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইডের অর্থাৎ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে জলবায়ুর পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের মতো জলবায়ুর ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোতে ঋতু বৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে, অসময়ের বৃষ্টি এবং খরা জনজীবনে ডেকে আনছে সীমাহীন দুর্ভোগ। তাই বলা যায় উদ্দীপকে উলিস্নখিত পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। ঘ. উদ্দীপকে উলিস্নখিত পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার মূল কারণ জলবায়ু পরিবর্তন আর এ সমস্যা মোকাবিলায় একজন সমাজকর্মী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি বিপন্ন অবস্থায় আছে। এদেশে প্রতিবছরই বন্যা, খরা, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটতে দেখা যায়। এর ফলে এদেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার জমির ফসল, পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য কমে যাচ্ছে। তাই এ ধরনের সমস্যা মোকাবিলায় সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি একজন সমাজকর্মী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। একজন সমাজকর্মী জলবায়ুর ঝুঁকি নিরূপণে কাজ করতে পারেন। এর ফলে জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের জীবন ও জীবিকায় কী ধরনের ক্ষতি করে তা চিহ্নিত করা যায়। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলার জন্য তিনি বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম আয়োজন করতে পারেন। ভিডিও প্রদর্শনী; ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ায় এ সম্পর্কে প্রচারণা চালাতেও সমাজকর্মী কাজ করতে পারেন। এছাড়া সমাজকর্মীরা দুর্যোগজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় কাজ করছে এরকম সংস্থার মধ্যে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করতে পারেন। আবার জলবায়ু বিপন্ন হওয়ার জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ প্রয়োগ করা জরুরি। এক্ষেত্রে সমাজকর্মীরা সামাজিক কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে ভূমিকা রাখতে পারেন। এছাড়া সমাজকর্মীরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে কমানো যায় বা কীভাবে এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা যায় সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন। এজন্য তিনি ব্যক্তি, দল ও সমষ্টি পর্যায়ে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারেন। সেই সাথে তিনি এসব কার্যক্রমে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা বাড়াতে পারেন। সার্বিক আলোচনা থেকে বলা যায় জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। তবে যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে এর ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে আনা যেতে পারে। এক্ষেত্রে একজন সমাজকর্মী সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারেন। ৩. দিবা অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। সে ঔঝঈ পরীক্ষার জন্য ফরমফিলাপ করেছে। কিন্তু পরীক্ষার সময় স্বামী ও অভিভাবকগণ পরীক্ষা দিতে বারণ করায় পরীক্ষা দিতে পারে নাই। যার ফলশ্রম্নতিতে দিবার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এটি একটি সামাজিক অপ্রত্যাশিত অবস্থা। ক. গ্রিক চৎড়নষবসধ শব্দের অর্থ কী? খ. যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি- ব্যাখ্যা করো। গ. উদ্দীপকে উলিস্নখিত ঘটনাটি তোমার পাঠ্য বইয়ের কোন সমস্যার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ? আলোচনা করো? ঘ. উক্ত ঘটনাটি নিরসনের জন্য যে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে তা যথার্থ কিনা বিশ্লেষণ করো। উত্তর: ক. গ্রিক 'চৎড়নষবসধ' শব্দের অর্থ সমস্যা বা অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি। খ. যৌতুক প্রথাকে একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যৌতুক প্রথা বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করছে। ২০১৬ সালে এদেশে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৩৯ জন নারী, মামলা হয়েছে ৯৫টি। এছাড়া একই কারণে ১২৬ জন নারীর ওপর শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। যৌতুক প্রথার কারণে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যাও সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে আছে- দারিদ্র্য, নারী উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ, দাম্পত্য কলহ, পরিবারের মর্যাদাহানি, হত্যা ও আত্মহত্যা ইত্যাদি। মূলত এ কারণেই যৌতুককে সামাজিক ব্যাধি বলা হয়। গ. উদ্দীপকে উলিস্নখিত ঘটনাটি বাল্যবিবাহের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। বাল্যবিবাহ বলতে অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিবাহকে বোঝানো হয়। এক্ষেত্রে বয়সকে বিয়ের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। বাংলাদেশের শিশু আইন-২০১৩ অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু হিসেবে বিবেচিত হবে। তাই আইনত ১৮ বছরের নিচের কোনো মেয়ে বা ছেলের বিবাহ সম্পন্ন হলে তাকে বাল্যবিবাহ বলা হয়। পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় নারীর মর্যাদাহীনতা এবং ক্ষমতায়নের অভাবের কারণে আবহমানকাল থেকে বাল্যবিবাহ প্রচলিত আছে। দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, শিক্ষার অভাব, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এ সমস্যাকে আরও উৎসাহিত করছে। ফলে সাবালক হওয়ার আগেই বাবা-মা মেয়ের বিয়ে দেন। এর ফলে তার পড়াশোনা বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য সমস্যার সূত্রপাত হয়। উদ্দীপকের দিবা অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। সে জেএসসি পরীক্ষার ফরমফিলাপ করলেও স্বামী ও অভিভাবকদের বাধায় পরীক্ষা দিতে পারেনি। এতে বোঝা যায়, দিবা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই তাকে বিবাহ দেওয়া হয়েছে। তাই বলা যায়, উদ্দীপকে দিবার ঘটনা বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক সমস্যাকে ইঙ্গিত করছে। ঘ. বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক সমস্যা নিরসনের জন্য ২০১৭ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, সময় এবং পরিস্থিতির বিচারে একে যথার্থ বলা যায়। স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে বাল্যবিবাহের প্রকোপ বেশি লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের মাত্রা হ্রাস পেলেও তা থেমে নেই। ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুসারে বর্তমানে দেশে বাল্যবিবাহের হার ৫৯ শতাংশ অর্থাৎ দেশে বাল্যবিবাহ হচ্ছে ৩৯ লাখ ৩০ হাজার শিশুর। ক্রমবর্ধমান এই হার হ্রাস করার জন্য প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন। এ লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ প্রণীত হয়। এ আইনের ধারা ৭, ৮ ও ৯-এ বাল্যবিবাহ করার শাস্তি, সংশ্লিষ্ট বাবা-মা ও অন্যদের শাস্তি এবং বিয়ে সম্পাদন বা পরিচালনা করার শাস্তি নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ধারা ৮ অনুযায়ী বাবা-মা বা অভিভাবক অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি আইনত বা আইন-বহির্ভূতভাবে কোনো অপধাপ্তবয়স্ক ছেলে বা মেয়েকে বিয়ে দিলে বা বিয়ে দেওয়ার অনুমতি দিলে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এর শাস্তি হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তি অনধিক ২ বছর ও ছয় মাস কারাদন্ড বা পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হবেন। এছাড়া বাল্যবিবাহ পরিচালনা করার জন্য ও সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। উদ্দীপকের দিবার স্বামী ও অভিভাবকদের কার্যক্রম এ আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সার্বিক আলোচনা থেকে তাই বলা যায়, বাল্যবিবাহের মতো সমস্যা সমাধানে ২০১৭ সালে প্রণীত আইনটি যুগোপযোগী ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে আইনের কঠোর প্রয়োগ ঘটানো জরুরি। হ পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়