শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১
তাজমহল

ইতিহাস ও ঐতিহ্য

শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
  ০৫ মে ২০২৪, ০০:০০
ইতিহাস ও ঐতিহ্য

তাজমহল মুঘল সম্রাট শাহজাহানের এক অমর সৃষ্টি।

তাজমহল ভারতের উত্তরপ্রদেশ আগ্রায় অবস্থিত একটি রাজকীয় সমাধি। মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম যিনি মমতাজমহল নামে পরিচিত, তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই অপূর্ব সৌধটি নির্মাণ করেন। সৌধটির নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে যা সম্পূর্ণ হয়েছিল প্রায় ১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে। পৃথিবীজুড়ে তাজমহল ভালোবাসার একটি অপরূপ নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত।

আরজুমান্দ বানু বেগম মমতাজ ছিলেন শাহজাহানের তৃতীয় স্ত্রী। ১৬৩১ সালে ৩৯ বছর বয়সে ১৪তম সন্তান জন্মের সময় মমতাজের মৃতু্য হয়। প্রিয় পত্নীর স্মৃতিকে অম্স্নান করে রাখার উদ্দেশ্যে তার সমাধিকে ঘিরে সম্রাট শাহজাহান তাজমহল নির্মাণ করেন।

মমতাজের মৃতু্যর পরপরই তাজমহলের নির্মাণ কাজে হাত দেওয়া হয়নি। মৃতু্যর পর তার দেহ আগ্রার একটা জায়গায় রাখা হয়। সেখানে সযত্নে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে দীর্ঘ ৯ মাস রাখার পর যখন তাজমহল নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়, তখন তার মরদেহ সেখানে আনা হয়।

তাজমহলের নকশা প্রথমে কাঠের ছাঁচে তৈরি করা হয়েছিল। ভারতবর্ষের বাইরে থেকেও ভাস্কর্য শিল্পে দক্ষ একাধিক গুণী ব্যক্তিদের তাজমহলের নির্মাণ কাজে নিযুক্ত করা হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায় সর্বমোট ১৫ জন নির্মাণবিদ তাজমহল তৈরিতে সক্রিয়ভাবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন।

স্থাপত্য কীর্তি পৃথিবীতে বহু আছে কিন্তু পৃথিবীর অন্য কোনো স্থাপত্য তাজমহলের অনুরূপ খ্যাতি লাভ করতে পারে নাই। এর জন্য সম্রাট শাহজাহানকে অনেক বিনিদ্র রজনী যাপন করতে হয়েছে। সমগ্র পৃথিবী তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছেন সর্বোৎকৃষ্ট মহার্ঘ পাথর।

প্রচুর সাদা মার্বেল পাথর নিয়ে আসা হয়েছিল জয়পুরের মাকরানা আর রাইওয়ালা থেকে। লাল বেলে পাথর আনা হয়েছিল ফতেপুর সিক্রি থেকে। এ ছাড়া বাগদাদ, ইয়ামেন, গ্র্যান্ড তিব্বত, সিংহল, কানাডা, দক্ষিণ ভারত, মিশরের নীলনদ, গঙ্গা, গোয়ালিয়র, পারস্য, কুমায়ুন, মহারাষ্ট্র, জেহেরি, মাকরান, খামাচ, বিন্ধ্যাচল পর্বত, জব্বলপুর, রাজস্থান, হিমাচল থেকে সমতল, বাংলার সন্দ্বীপ, মহেশখালী দ্বীপ- তার দৃষ্টি থেকে কিছুই বাদ পড়েনি। সর্বসাকুল্যে ১৭ হাজার মণ পাথর সংগৃহীত হয়েছিল।

তাজমহলে মহামূল্যবান চুনি ছিল- ৬০ মণ, পান্না- ১০০ মণ, নীলকান্ত মণি- ১৬০ মণ, নানান রঙের সংমিশ্রণে তৈরি উজ্জ্বল মণি- ১৮০ মণ, ফিরোজা রঙের মণি- ৯০ মণ, গোয়ালিওর স্টোন- ৯৯০ মণ, উজ্জ্বল দু্যতিময় পাথর- ৮০ মণ, চুম্বক লোহার আকর ৮০ মণ এ ছাড়া আরও ২৩০ মণ মহামূল্যবান মণি এবং খাদবিহীন স্বর্ণের বার ছিল আনুমানিক ২০০ মণ। আজ থেকে সাড়ে ৩০০ বছর আগে সম্রাট শাহজাহান মণ মণ স্বর্ণ, হীরা, চুনি, পান্না, মণি-মানিক্য সংগ্রহ করে সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য তাজমহলে লাগিয়ে ছিলেন।

পুরো তাজমহল ১৮০ ফুট উঁচু যার প্রধান গম্বুজটি ২১৩ ফুট উঁচু এবং ৬০ ফুট চওড়া এবং এর চারপাশে চারটি মিনার আছে যার প্রতিটির উচ্চতা ১৬২.৫ ফুট। পুরো কমপেস্নক্সটির আকার ১৯০২ বাই ১০০২ ফুট। শুধু তাজমহলটি ১৮৬ বাই ১৮৬ ফুট মার্বেল পাথরের উপর নির্মিত। এর প্রধান প্রবেশদ্বার ১৫১ বাই ১১৭ ফুট চওড়া এবং ১০০ ফুট উঁচু।

ভোরের আলোয় এক হালকা গোলাপির মূর্ছনায় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে তাজমহল। চাঁদনি রাতে একটি হালকা নীল রঙের আভায় এক মনোমুগ্ধকর রূপ নেয়। এই পরিবর্তনগুলো তাজমহলকে দিয়েছে অনন্য এক বৈচিত্র্য।

এটি নির্মাণ করতে সুদক্ষ ২০ হাজার শ্রমিকের ২২ বছর সময় লেগেছিল। তাজমহল নির্মাণের জন্য তিনি ২২ হাজার মানুষ নিযুক্ত করেন, যারা ছিলেন শ্রমিক, স্টোনকাটার, চিত্রশিল্পী, সূচিকর্মশিল্পী ও ক্যালিগ্রাফার। নির্মাণসামগ্রী বহনের জন্য ১০০০ হাতি ব্যবহার করা হয়েছিল।

তাজমহলের ভেতর ও বাইরের ক্যালিগ্রাফির চমৎকার কাজ আছে। মমতাজমহলের সমাধি ক্ষেত্রেও তার পরিচিতি ও প্রশংসার শিলালিপি দেখা যায়। সমাধিক্ষেত্রের একপাশে আলস্নাহর ৯৯ নাম ক্যালিগ্রাফিক শিলালিপিতে অঙ্কিত আছে।

বর্তমানে তাজমহল বাগান, গেস্টহাউস ও মসজিদ দিয়ে ঘেরা ১৭ হেক্টর জায়গা নিয়ে গঠিত। সম্রাট শাহজাহান যমুনা নদীতে বসে তার এই স্বপ্নের সমাধিটিকে দেখতেন। বর্তমানে নদীটি শুষ্ক হয়ে গেছে।

তাজমহলে একটি সড়ঙ্গ রয়েছে যা যমুনা নদীর ধার থেকে শুরু হয়ে তাজমহল গিয়ে শেষ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই সুড়ঙ্গটি সম্রাট শাহজাহান যমুনা নদীর ধার থেকে তাজমহলে আসার জন্য ব্যবহার করতেন।

তাজমহলের প্রবেশ পথটি লাল বেলে পাথরে তৈরি। এটি প্রায় ১০০ ফুট উঁচু। ১৮৭ ফুট উঁচু মূল মিনারটি রয়েছে ৬০ ফুট ব্যাসের জায়গাজুড়ে। মূল মিনারের চারপাশে রয়েছে ছোট ছোট মিনার। এগুলোর উচ্চতা ১০৮ ফুট।

\হতাজমহলের নির্মাণশৈলীতে আরেকটি রহস্যময় দিক হলো- আপনি যত সামনের দিকে যাবেন, মনে হবে সেটি আকারে ছোট হচ্ছে। আর যখন দূরে সরে আসবেন, মনে হবে বড় হচ্ছে। তাজমহল নির্মাণের পর যাতে এর মতো আর কোনো সুন্দর স্থাপনা নির্মাণ করতে না পারে, সে কারণে সব শ্রমিকের হাত কেটে ফেলার নির্দেশ দেন সম্রাট।

মুঘলদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে তাজমহলের প্রতি নেমে আসে দুর্যোগ। আসল মণি-মুক্তা, স্বর্ণ তাজমহলের গায়ে এখন আর নেই। একদিকে বাগান ধ্বংস করা হয়, অন্য দিকে পানিপ্রবাহের স্থাপনাগুলো নষ্ট করা হয়। আরেক দিকে চলে অবাধ লুণ্ঠন।

স্থাপত্যের জনক হিসেবে খ্যাত সম্রাট শাহজাহান জগদ্বিখ্যাত আগ্রার তাজমহল ছাড়াও আরও যেসব শিল্পকর্ম তৈরি করে ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন তাদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো- মতি মসজিদ, দিলিস্নর জুমা মসজিদ, ময়ূর সিংহাসন, আগ্রার খাসমহল, শিষমহল, দিলিস্নর দিওয়ান-ই-আম, দিওয়ান-ই-খাস এবং দিলিস্নর উপকণ্ঠে শাহজাহানাবাদনগরী প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি তার উলেস্নখযোগ্য কীর্তি। ১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিল সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকাল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে