বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৮ আশ্বিন ১৪৩১
ফতেপুর সিক্রি

ইতিহাস ও ঐতিহ্য

শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
  ০৩ মে ২০২৪, ০০:০০
ইতিহাস ও ঐতিহ্য

ফতেপুর সিক্রি ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রা জেলার একটি শহর। ১৫৭১ থেকে ১৫৮৫ সাল পর্যন্ত সম্রাট আকবর শহরটিকে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী ঘোষণা করেন। কিন্তু পরে ১৬১০ সালে শহরটি সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা হয়।

ফতেপুর সিক্রি নামটির উৎপত্তি হয় সিকরি নামের গ্রাম থেকে। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ১৯৯৯-২০০০ সালের খননকার্য থেকে জানা যায়, আকবর এখানে রাজধানী স্থাপন করার আগে থেকে এখানে মানুষের বসবাস ছিল। সম্রাট বাবর ফতেপুর সিক্রি খুব পছন্দ করতেন। তার সৈন্যেরা এখানকার শুকরি ঝিলের জল ব্যবহার করতেন, তাই বাবর জায়গাটির নাম দিয়েছিলেন শুকরি। শুকরি অর্থ ধন্যবাদ। বাবর সিক্রিকে বিনোদনের জন্য ব্যবহার করতেন এবং এর সীমান্ত-অঞ্চলে মহারানা সংগ্রাম সিংহকে পরাজিত করেছিলেন।

অ্যানেট বেভারিজ 'বাবরনামা'র অনুবাদে লিখেছেন, বাবর সিকরিকে শুকরি বলতেন। তার স্মৃতিচারণাতে বাবর লিখেছেন, তিনি রাণা সংগ্রাম সিংহকে পরাজিত করার পরে এখানে 'বিজয়ের উদ্যান' নামে এক বাগান বানিয়েছিলেন। গুলবদন বেগমের 'হুমায়ুননামা'তে লেখা আছে, বাবর সেই বাগানে একটি আটকোনা চাতাল বানিয়েছিলেন যা তিনি বিনোদন ও লেখার জন্য ব্যবহার করতেন। একটি নিকটবর্তী ঝিলের মাঝখানে তিনি একটি বেদি নির্মাণ করেন। হিরণ মিনার থেকে এক কি.মি. দূরে একটি পাথরের চড়াই ছিল যার তলায় বাওলি ছিল। এখানে একটি পাথরের ফলকে খোদাই করা ছিল বাবরের বিজয়ের ইতিহাস।

আগে এখানে শেখ সেলিমের খানকা ছিল। ১৫৬৯ সালে আকবরপুত্র জাহাঙ্গীরের জন্ম হয় এইখানে। যে শেখ জাহাঙ্গীরের জন্মের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে আকবর এখানে একটি ধর্মীয় প্রাঙ্গণের নির্মাণ করেন। জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় জন্মদিনের পরে আকবর এখানে একটি প্রাচীর-ঘেরা শহর এবং এক প্রাসাদ নির্মাণ করেন। ১৫৭৩ সালে আকবরের গুজরাত বিজয়ের পরে শহরটির নাম হয়ে যায় ফতেপুর সিক্রি 'বিজয়ের শহর'। মূল প্রবেশদ্বারটি বুলন্দ দরওয়াজা নামে পরিচিত।

আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে, আকবর ফতেপুর সিক্রি নির্মাণে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন এবং সম্ভবত এর স্থাপত্যশৈলীর নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। তৈমুর লং-কর্তৃক প্রচলিত পারসিক আদাল প্রক্রিয়ার আড়ম্বর পুনরুজ্জীবিত করতে আকবর প্রাঙ্গণটি পারসিক নীতিতে নির্মাণ করেন। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবে এটি ভারতীয় আদলে পরিবর্তিত হয়। ফতেপুর সিক্রির আশপাশে বেলেপাথরের প্রাচুর্য্য থাকায় এখানকার অধিকাংশ অট্টালিকা লাল রঙের। প্রাসাদ প্রাঙ্গণে জ্যামিতিকভাবে সজ্জিত বেশ কিছু স্বতন্ত্র চাতাল দেখতে পাওয়া যায় যা আরব ও মধ্য এশিয়ার তাঁবু-আকৃতির বিন্যাসের অনুকরণে বানানো। সমগ্র ফতেপুর সিক্রি এইভাবে আকবরের দুর্দান্ত শিল্পভাবনা ও তার মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের স্থাপত্যকলার সংমিশ্রণ ঘটানোর ক্ষমতা তুলে ধরে এবং একটি স্বতন্ত্র স্থাপত্যধারার প্রচলন করে।

কিন্তু প্রাসাদটি নিকটবর্তী একটি ঝিলের উৎস্যমুখ বন্ধ করে দেয় এবং আশপাশের জল-সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়। এছাড়া প্রাসাদটি রাজপুতানার কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় শত্রম্নদ্বারা আক্রমণের ভয়ও ছিল। এইসব কারণে প্রাসাদটিকে ১৫৮৫ সালে বর্জন করা হয় এবং রাজধানী লাহোরে স্থানান্তরিত করা হয়। আকবর ১৬০১ সালে কিছুদিনের জন্য এখানে ফিরে এলেও পাকাপাকিভাবে আর ফেরেননি। পরবর্তীকালে মুঘল সম্রাট মোহম্মদ শাহ (১৭১৯-১৭৪৮) এবং তার প্রতিনিধি সৈয়দ হাসান আলি খান বরহেকে এখানে হত্যা (১৭২০) করা হয়। মারাঠাদের দিলিস্ন বিজয়ের পরে তারা এই প্রাসাদের দখল নিলেও পরে তা ইংরেজদের হস্তগত হয়। তারা এটিকে সদর দপ্তর ও সেনা-ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করেন।

কয়েক শতাব্দী ধরে একটানা ব্যবহারের দরুন দুই মাইল লম্বা এবং এক মাইল চওড়া প্রাসাদ-প্রাঙ্গণের অধিকাংশ অংশ অক্ষত রয়েছে। এটির তিন দিক এখনো পাঁচ মাইল লম্বা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, যা এর প্রতিষ্ঠার সময়ে বানানো হয়েছিল। প্রাসাদ এবং সংলগ্ন মসজিদটি ব্যবহৃত হতে থাকলেও শহরটি ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হতে থাকে। আগ্রা রোডের 'নহবত খানা' প্রবেশদ্বারের কাছে পুরনো শহরের বাজারের কিছু ধ্বংসাবশেষ ছাড়া অধিকাংশ জায়গা জুড়ে এখন রয়েছে খালি ও অনুর্বর জমি। আধুনিক শহরটি প্রাসাদের পশ্চিমদিকে অবস্থিত। এটি ১৮৬৫ থেকে ১৯০৪ পর্যন্ত পৌরসভার স্বীকৃতি পায়। ১৯০১ সালে এই জায়গার জনসংখ্যা ছিল ৭,১৪৭। যদিও আকবরের সময়ে অঞ্চলটি পশমের কাপড় ও রেশমী সুতা কাটার জন্যে বিখ্যাত ছিল, এটি পরে স্থপতি ও ভাস্করদের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। সিক্রি গ্রামটি এখনো এর কাছে অবস্থিত।

ফতেহপুর সিক্রি পাথুরে পর্বত, ৩ কিলোমিটার (১.৯ মা) দৈর্ঘ্য এবং ১ কি.মি. (০.৬২ মা) প্রশস্ত এবং প্রাসাদ শহরটি একটি ৬ কি.মি. (৩.৭ মা) প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত, এর চতুর্থ সীমানাসহ তিনদিকে প্রাচীর। শহরটি প্রায় ৪০ মিটার উঁচু পর্বতমালার চারপাশে সংগঠিত হয়েছে এবং এটি প্রায় একটি রম্বসের আকারে পড়ে। স্থল কাঠামোগুলির সাধারণ বিন্যাস, বিশেষত 'উদ্যান এবং পরিষেবা এবং সুবিধার ধারাবাহিক এবং সংক্ষিপ্ত ধাঁচ, যা শহরটির বৈশিষ্ট্যযুক্ত ছিল নগর প্রত্নতাত্ত্বিকদের এই সিদ্ধান্তে নিয়ে আসে যে ফতেহপুর সিক্রিটি মূলত তার বিখ্যাত বাসিন্দাদের অবসর এবং বিলাসবোধের জন্য নির্মিত হয়েছিল।

এটি ৫ মাইল (৮.০ কি.মি.) দীর্ঘ দুর্গের প্রাচীর বরাবর গেটগুলোর মাধ্যমে অ্যাক্সেস করা যায়, যথা- দিলিস্ন গেট, লাল ফটক, আগ্রা ফটক এবং বীরবলের গেট, চন্দনপাল গেট, দি গওয়ালিয়র গেট, তেহর গেট, ছোর গেট এবং আজমেরি গেট। প্রাসাদটিতে রানী যোধা বাইয়ের জন্য গ্রীষ্মের প্রাসাদ এবং শীতের প্রাসাদ রয়েছে।

ফতেহপুর সিকির দর্শনীয় স্থানসমূহ হলো- বুলন্দ দরওয়াজা, জামে মসজিদ, সেলিম চিশতির মাজার, আনারকলির জীবন্ত কবর বা সুড়ঙ্গ, বীরবলের প্রাসাদ, আস্তাবল ও মীনাবাজার, হাম্মামখানা, পাঁচমহল বা পঞ্চমহল, অনুপ তালাও, যোধাবাঈয়ের প্রাসাদ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে