ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল বা ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধ পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অবস্থিত রানি ভিক্টোরিয়ার একটি স্মৃতিসৌধ। উলেস্নখ্য, ভিক্টোরিয়া ভারতের সম্রাজ্ঞী উপাধির অধিকারী ছিলেন। আগাগোড়া শ্বেতপাথরের তৈরি মহারানি ভিক্টোরিয়ার নামাংকিত এই স্মৃতিসৌধটি বর্তমানে একটি জাতীয় প্রদর্শনীশালা জাদুঘর এবং কলকাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন আকর্ষণ।
এটি কলকাতার বিখ্যাত গড়ের মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত স্মৃতিভবন। ১৯০১ সালে ৯৪ বছর বয়সে মহারানি ভিক্টোরিয়া মারা যাওয়ার পর তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে সাদা মার্বেল পাথরের এই ভবনটি নির্মিত হয়। লর্ড কার্জন এই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তার মূল পরিকল্পনার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল বিশাল বাগিচার মাঝে একটি সৌধ এবং সেই সঙ্গে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের স্মৃতিবাহী নানা সামগ্রী সমৃদ্ধ একটি জাদুঘর নির্মাণ।
১৯০৬ সালের ৪ জানুয়ারি এই ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন প্রিন্স অফ ওয়েলস হিসেবে ভারত সফরে আসা পরবর্তীকালের রাজা পঞ্চম জর্জ। ১৯২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর এটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রিন্স অফ ওয়েলস ও পরবর্তীকালের রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড।
স্মৃতিসৌধটিতে অনেক বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ একটি সংকর রীতির প্রকাশ ঘটেছে। যেমন- ইতালিয় রীতির মূর্তি, মুগলরীতির গম্বুজ, তাজমহলের ন্যায় সাদা মার্বেলের ব্যবহার, সুউচ্চ উন্মুক্ত স্তম্ভশ্রেণি। সবকিছু মিলিয়ে এটি ঔপনিবেশিক স্থাপত্যশৈলীর এক অপূর্ব নিদর্শন। ভারতে ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিটি গড়ে উঠেছিল ইউরোপীয় রীতির সঙ্গে ইন্দো-ইসলামিক রীতির যথার্থ মিশ্রণে। ভারতে ইউরোপীয় উপনিবেশ এবং সেই সঙ্গে ব্রিটিশ শাসন ভারতের স্থাপত্যে এক গভীর প্রভাব বিস্তার করে। এই রীতির স্থাপত্যিক প্রকাশ দেখা যায় গির্জা, ব্যারাক, দুর্গ, আবাসিক ও প্রশাসনিক ভবন ইত্যাদিতে।
ব্রিটিশরা ভারতে স্থাপত্যশিল্পে নতুন কিছু কারিগরি শৈলীর সূচনা করে, যা ছিল সে সময়ে ভারতীয়দের ব্যবহৃত পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ভারতে ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতির শ্রেষ্ঠ নির্দশন। এটি স্বাধীন ভারতে আধুনিক স্থাপত্যরীতির পথ নির্দেশনা দিয়েছে।
বেলফাস্ট সিটি হলের স্থাপত্যশৈলীর আদলে ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধের নকশা প্রস্তুত করেন স্যার উইলিয়াম এমারসন। প্রথমে তাকে ইতালীয় রেনেসাঁ স্থাপত্যশৈলীতে স্মৃতিসৌধের নকশা প্রস্তুত করতে বলা হলেও, তিনি শুধু ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর প্রয়োগের বিরোধিতা করেন এবং ইন্দো-সারাসেনিক শৈলীর সঙ্গে মুঘল উপাদান যুক্ত করে মূল সৌধের নকশা প্রস্তুত করেন। ভিনসেন্ট জে ইস্চ ছিলেন এই সৌধের অধীক্ষক স্থপতি। সৌধ-সংলগ্ন বাগানটির নকশা প্রস্তুত করেছিলেন লর্ড রেডেসডেল ও স্যার জন প্রেইন। কলকাতার মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি সংস্থার ওপর নির্মাণকার্যের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল।
স্মৃতিসোধ ভবনের উত্তর এবং দক্ষিণ দু'দিকেই বিশাল ফটক। উত্তর ফটক থেকে ভবন পর্যন্ত চওড়া রাস্তার দু'দিকে দুই প্রকান্ড জলাধার একাধারে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রদর্শনের মনোরম শোভা বর্ধন করে। শ্বেতপাথরে নির্মিত সুবৃহৎ ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধটি অসাধারণ। সৌধের সর্বোচ্চ গম্বুজে বিউগল-ধারিণী বিজয়দূতীর একটি কালো ব্রোঞ্জমূর্তি রয়েছে। বায়ুপ্রবাহ শক্তিশালী হলে বল-বিয়ারিং যুক্ত একটি পাদপীঠের ওপর স্থাপিত মূর্তিটি হাওয়ামোরগের কাজ করে।
ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টের প্রেসিডেন্ট স্যার উইলিয়ম এমারসন এই ভবনের পরিকল্পনা ও নকশা প্রস্তুত করেন। তবে সুপারিনটেন্ডেন্ট আর্কিটেক্ট হিসেবে এর নির্মাণ কাজ তত্ত্বাবধান করেন ভিনসেন্ট জে ইস্চ (ঠরহপবহঃ ঔ ঊংপয)। ১৯০২ সালে এমারসন তাকে ভবনের মূল নকশার ওপর একটি স্কেচ দাঁড় করার দায়িত্ব দেন। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয় কলকাতার মেসার্স মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি।
স্যার উইলিয়ম এমারসন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের নকশা ইতালিয় রেনেসাঁর স্থাপত্যিক রীতিকে অনুসরণ করেই গড়ে তুলেছিলেন, যদিও তাজমহলের সাঙ্গে এর সাদৃশ্য বিদ্যমান। এমারসন এটিকে পশ্চিমা ডিজাইন হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও এতে ভারতীয় বৈশিষ্ট্যই প্রকাশ পায়। সাদা মার্বেল পাথরে এটি নির্মাণের জন্য লর্ড কার্জন প্রথম থেকেই জোরালো মত প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও এর গঠন প্রক্রিয়ায় তাজমহলের প্রভাব পরিদৃষ্ট হয়। যেমন- এর গম্বুজ, পার্শ্ববর্তী ক্লাস্টার্ড অষ্টভুজাকার গম্বুজ ছত্রী, সুউচ্চ জাঁকালো প্রবেশ তোরণ, উন্মুক্ত চত্বর, গম্বুজ আচ্ছাদিত কর্নার টাওয়ার ইত্যাদি। এমনকি এই দুই স্থাপত্যের উদ্দেশ্যের মধ্যেও সাদৃশ্য বিদ্যমান। তাজমহলের মতো এটিও এক সম্রাজ্ঞীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ২৫টি গ্যালারির সমন্বয়ে গঠিত। 'কুইন্স হল'টি আকর্ষণের মূল কেন্দ্র। এর সব দেওয়ালে মহারানির ঘোষণা লিপিবদ্ধ। তার স্মৃতি বিজড়িত বিভিন্ন ঘটনার অংকিত চিত্র যেমন- তাঁর সিংহাসন আরোহণ, তার বিয়ে, তার পুত্র ও উত্তরাধিকারীর ব্যাপটিস্টকরণ, রাজপুত্রের বিবাহ, ফ্রগমোরে তার বাসভবন ইত্যাদি দ্বারা গ্যালারি সজ্জিত। রানির ব্যবহৃত কিছু সামগ্রী; যেমন- শৈশবে ব্যবহৃত তার পিয়ানো, উইন্ডসোর প্রাসাদে দৈনন্দিন চিঠি-পত্র লেখার জন্য ব্যবহৃত তার টেবিল ও চেয়ার, ভারতীয় প্রজাদের উদ্দেশ্যে লেখা তার শেষ চিঠি ইত্যাদি।
মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে আরও আছে বিভিন্ন সময়ে ভারতবর্ষে আসা বিখ্যাত ব্রিটিশ নাগরিকদের প্রতিকৃতি; যেমন- মেকলে, কিপলিং, বিশপ হেবার, উইলিয়ম হিকি প্রমুখ। নিজ যোগ্যতায় ভারতীয় কিছু ব্যক্তিও এখানে স্থান করে নিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন কেশবচন্দ্র সেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর। কিছু দলিলপত্রও এখানে সংরক্ষিত আছে। এর মধ্যে রয়েছে নন্দকুমারের জালিয়াতি সম্পর্কিত দলিল, যার জন্য তাকে অন্যায়ভাবে প্রাণদন্ডে দন্ডিত করা হয়। এছাড়াও আছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্মৃতিবাহী বিভিন্ন নিদর্শনাদি। যেমন- রানি মেরী, পঞ্চম জর্জ ও অন্যদের আবক্ষ মূর্তি, ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে দখলকৃত ফরাসি কামান ইত্যাদি।