আজকের যায়যায়দিন

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি নগর উদ্যান। এটি পূর্বে রমনা রেসকোর্স ময়দান নামে পরিচিত ছিল। এক সময় ঢাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ সৈন্যদের সামরিক ক্লাব এখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরবর্তীতে এটি রমনা রেস কোর্স এবং তারপর রমনা জিমখানা হিসেবে ডাকা হতো। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পর মাঠটিকে কখনো কখনো ঢাকা রেস কোর্স নামে ডাকা হত এবং প্রতি রবিবার বৈধ ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর রমনা রেসকোর্স নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহ?রাওয়ার্দীর নামানুসারে রমনা রেসকোর্স ময়দানের নাম পরিবর্তন করে 'সোহরাওয়ার্দী উদ্যান' রাখা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণ এখানেই প্রদান করেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বার পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই উদ্যানেই আত্মসমর্পণ করে মিত্র বাহিনীর কাছে। রেসকোর্স ময়দানের অদূরে অবস্থিত তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান হিসেবে প্রথমে নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীকালে আত্মসমর্পণের জন্য এই মাঠটি নির্বাচন করা হয়।

ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি শাসনামলে ঢাকার চারটি থানার একটির নামকরণ করা হয়েছিল রমনা। বর্তমানেও ঢাকার ২০টি থানার একটি হচ্ছে রমনা।

রমনার ইতিহাস শুরু হয় ইংরেজি ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে যখন মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে সুবাহদার ইসলাম খান ঢাকা নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ সময় ঢাকার উত্তর শহরতলিতে দুটি চমৎকার আবাসিক এলাকা গড়ে ওঠে। সুবাহদার ইসলাম খান চিশতির ভাইয়ের নামানুসারে এর একটির নামকরণ করা হয় মহলস্না চিশতিয়া এবং সুবাহদার ইসলাম খানের একজন সেনাধ্যক্ষ সুজা খানের নামানুসারে অপর এলাকাটির নামকরণ হয় মহলস্না সুজাতপুর। এই এলাকায় তখন উন্নত বসতবাড়ি ছাড়াও মসজিদ, বাগান, সমাধিসৌধ, মন্দির ইত্যাদি গড়ে ওঠে। মুগল সাম্রাজের পতনের পর রমনা ধীরে ধীরে তার পুরানো গৌরব হারিয়ে ফেলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে সরকারি কাগজপত্রে রমনার নাম তেমন একটা চোখে পড়ে না। বস্তুত ওই সময় রমনা ছিল একটি জঙ্গলাকীর্ণ পরিত্যক্ত এলাকা যেখানে ধ্বংসপ্রাপ্ত দালানকোঠা, মন্দির, সমাধি ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।

ব্রিটিশ আমলে রমনা ময়দানটি ঘোড়দৌড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। প্রতি শনিবার হতো ঘোড়দৌড়। এটা ছিল একই সঙ্গে ব্রিটিশ শাসক ও সর্বস্তরের মানুষের চিত্তবিনোদনের একটি স্থান।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পরও রমনা ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবেই থেকে যায়। শাহবাগ থেকে ইডেন বিল্ডিং (সচিবালয়) পর্যন্ত নতুন একটি রাস্তা করা হয় এবং এই রাস্তার পূর্বদিকের অংশে রমনা পার্ক নামে একটি চমৎকার বাগান গড়ে তোলা হয়।

১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পেলে রমনা রেসকোর্সে তাকে এক নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া এবং এখানেই তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৭১ সালের ৩ জানয়ারি আওয়ামী লীগ রমনা রেসকোর্সে এক মহাসমাবেশের আয়োজন করে এবং এই সমাবেশে জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যগণ প্রকাশ্যভাবে জনসভায় শপথ গ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আবার এই রমনাতে এক মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। এই ঘটনার পর এখানে অনুষ্ঠিত আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ তারিখে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বক্তব্য রাখেন। এ সময় থেকে রমনা রেসকোর্স গুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক সমাবেশের স্থানে পরিণত হয়।

১৯৭০ দশকের শেষভাগ থেকে শুরু করে এখানে প্রচুর গাছ-গাছালি রোপণ করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালের পর এলাকাটিকে সবুজে ঘেরা পার্কে পরিণত করা হয়। পার্কের একপাশে শিশুদের জন্য একটি বিনোদন কেন্দ্র তথা পার্ক গড়ে তোলা হয়। এখানে শিশুদের জন্য নানা ধরনের আকর্ষণীয় খেলাধুলা, খাবার রেস্তোরাঁ এবং ছোটখাটো স্মারক জিনিসপত্র ক্রয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংক্রান্ত যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে এখানে 'শিখা চিরন্তন' স্থাপন করা হয়েছে এবং একইসাথে তার পাশেই যেখানে পাকিস্তানি সেনারা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিল সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ।

১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে এখানে স্বাধীনতা স্তম্ভ ও শিখা চিরন্তন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। স্বাধীনতা স্তম্ভ প্রকল্পের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ জনতার দেয়াল নামে ২৭৩ ফুট দীর্ঘ একটি দেয়ালচিত্র। এটি ইতিহাসভিত্তিক টেরাকোটার পৃথিবীর দীর্ঘতম মু্যরাল। এর বিষয়বস্তু ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস। এ ছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খনন করা হয়েছে একটি কৃত্রিম জলাশয় বা লেক। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে উদ্যানের ভেতর ঢাকা জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা সংবলিত একটি স্থাপনা তৈরি করা হয়। জনতার দেয়াল টেরাকোটা মু্যরালের নিচের অংশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্বাধীনতা জাদুঘর। এখানে দেশের বৃহত্তম মুক্তমঞ্চ অবস্থিত, যেটি ২০১১ সালের ৭ মার্চ থেকে বিভিন্ন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে।

বর্তমানে ফাঁকা জায়গা তুলনামূলকভাবে কম। যদিও ছোটখাটো বৈশাখী মেলা জাতীয় অনুষ্ঠানের পরিসর এখনো আছে কিন্তু কোনরূপ জনসভা করার অবকাশ আর নেই। এটি সময় কাটানো, হাঁটাহাঁটিঁ প্রভৃতির জন্য উপযুক্ত।