সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম জোয়ারধৌত গরান বনভূমি (সধহমৎড়াব ভড়ৎবংঃ)। কর্কটক্রান্তির সামান্য দক্ষিণে ভারত ও বাংলাদেশের উপকূল ধরে বিস্তৃত ২১ক্ক৩০ক্ম-২২ক্ক৩০ক্ম উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯ক্ক০০ক্ম-৮৯ক্ক৫৫ক্ম পূর্ব দ্রাঘিমার মধ্যবর্তী স্থানে এ বনের অবস্থান। বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত এটি একটি প্রশস্ত বনভূমি। যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম। সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ অংশে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত।
পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার কিছু অংশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখন্ড বনভূমি।
১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬,৫১৭ বর্গ কিলোমিটার (৬৬%) রয়েছে বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ (৩৪%) রয়েছে ভারতের মধ্যে।
প্রায় ২০০ বছর পূর্বে মূল সুন্দরবনের এলাকা ছিল প্রায় ১৬,৭০০ বর্গ কিমি। বর্তমানে সংকুচিত হয়ে প্রকৃত আয়তনের এক-তৃতীয়াংশে পৌঁছেছে। ব্রিটিশ ভারত বিভাগের পর বনের দুই-তৃতীয়াংশ পড়েছে বাংলাদেশে, বাকিটা ভারতে। এই বনভূমির বর্তমান আয়তন হবে প্রায় ৪,১১০ বর্গ কিমি, এর প্রায় ১,৭০০ বর্গ কিমি জলাভূমি। গোটা সুন্দরবন দুটি বন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। এখানে আছে চারটি প্রশাসনিক রেঞ্জ- বুড়িগোয়ালিনি, খুলনা, চাঁদপাই এবং শরণখোলা; আর ১৬টি ফরেস্ট স্টেশন। ব্যবস্থাপনার সুবিধার জন্য সুন্দরবনকে নয়টি বস্নক এবং ৫৫টি কোম্পার্টমেন্ট-এ ভাগ করা হয়েছে। ১৮৭৫ সালে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ বনভূমির প্রায় ৩২,৪০০ হেক্টর এলাকাকে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ৬ ডিসেম্বর সুন্দরবন ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
১৯৯৯ সাল থেকে টঘঊঝঈঙ ডড়ৎষফ ঐবৎরঃধমব ঝরঃব-এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আদেশ (সংশোধন), ১৭৭৪-এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৭ সালে সুন্দরবনের অভয়ারণ্যগুলো (ংধহপঃঁধৎরবং) প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশ বস্তুত একই নিরবচ্ছিন্ন ভূমিখন্ডের সন্নিহিত অংশ হলেও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় ভিন্ন ভিন্ন নামে সূচিবদ্ধ হয়েছে; যথাক্রমে 'সুন্দরবন' ও 'সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান' নামে।
যে তিনটি এলাকা এতে অন্তর্ভুক্ত সেগুলো হচ্ছে : সুন্দরবন পশ্চিম (৯,০৬৯ হেক্টর), সুন্দরবন দক্ষিণ (১৭,৮৭৮ হেক্টর) এবং সুন্দরবন পূর্ব (৫,৪৩৯ হেক্টর)।
'সুন্দরবন' নামটি সম্ভবত সুন্দরী বৃক্ষের আধিক্যের কারণে (সুন্দরী-বন) অথবা সাগরের বন (সমুদ্র-বন) কিংবা এ বনভূমির আদিবাসী চন্দ্রবেদে থেকে উদ্ভূত। সাধারণভাবে গৃহীত ব্যাখ্যাটি হলো এখানকার প্রধান উদ্ভিদ সুন্দরী বৃক্ষের (ঐবৎরঃরবৎধ ভড়সবং) নাম থেকেই এ বনভূমির নামকরণ।
বাংলায় সুন্দরবন-এর আক্ষরিক অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা সুন্দর বনভূমি।সুন্দরী গাছ থেকে সুন্দরবনের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে, যা সেখানে প্রচুর জন্মায়। অন্যান্য সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এরকম হতে পারে যে, এর নামকরণ হয়তো হয়েছে 'সমুদ্র বন' বা 'চন্দ্র-বান্ধে (বাঁধে)' (প্রাচীন আদিবাসী) থেকে। তবে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় যে সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে। সুন্দরবন স্থানীয়ভাবে বাদা বা বাদাবন, হুলোবন, শুলোবন, মাল, মহাল হিসেবে পরিচিত। বাদা মানে জোয়ার-ভাটা বয়ে যায় যে বনে। ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় এই বাদার নাম হয়ে যায় মহাল, মধুমহাল, গোলমহাল।
মুঘল আমলে (১২০৩-১৫৩৮) স্থানীয় এক রাজা পুরো সুন্দরবনের ইজারা নেন। ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর এর কাছ থেকে স্বত্বাধিকার পাওয়ার পরপরই সুন্দরবন এলাকার মানচিত্র তৈরি করা হয়। বনাঞ্চলটি সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আসে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ভারতের তৎকালীন বাংলা প্রদেশে বন বিভাগ স্থাপনের পর থেকে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ ছিল। বনের উপর মানুষের অধিক চাপ ক্রমান্বয়ে এর আয়তন সংকুচিত করেছে। ১৮২৮ সালে ব্রিটিশ সরকার সুন্দরবনের স্বত্ববাধিকার অর্জন করে। এল টি হজেয ১৮২৯ সালে সুন্দরবনের প্রথম জরিপ কার্য পরিচালনা করেন। ১৮৭৮ সালে সমগ্র সুন্দরবন এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় সুন্দরবনের ৬,৫১৭ বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে পড়ে। যা বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় ৪.৩% এবং সমগ্র বনভূমির প্রায় ৬৬%।
সুন্দরবনের উপর প্রথম বন ব্যবস্থাপনা বিভাগের আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৯ সালে। ১৯৬৫ সালের বন আইন (ধারা-৮) মোতাবেক, সুন্দরবনের একটি বড় অংশকে সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয় ১৮৭৫-৭৬ সালে। পরবর্তী বছরের মধ্যেই বাকি অংশও সংরক্ষিত বনভূমির স্বীকৃতি পায়। এর ফলে দূরবর্তী বেসামরিক জেলা প্রশাসনের কর্তৃত্ব থেকে তা চলে যায় বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে। পরবর্তীকালে ১৮৭৯ সালে বন ব্যবস্থাপনার জন্য প্রশাসনিক একক হিসেবে বন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সদর দপ্তর ছিল খুলনায়। সুন্দরবনের জন্য ১৮৯৩-৯৮ সময়কালে প্রথম বন ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণীত হয়।
১৯১১ সালে সুন্দরবনকে ট্র্যাক্ট আফ ওয়াস্ট ল্যান্ড হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়, যা না তো কখনো জরিপ করা হয়েছে আর না তো কোনদিন শুমারির অধীনে এসেছে। তখন হুগলি নদীর মোহনা থেকে মেঘনা নদীর মোহনা পর্যন্ত প্রায় ১৬৫ মাইল (২৬৬ কিমি) এলাকা জুড়ে এর সীমানা নির্ধারিত হয়।
সুন্দরবনকে জালের মতো জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা। মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ, অর্থাৎ ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা, খাঁড়ি, বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত বনভূমিটি। জরিপ মোতাবেক ১০৬ বাঘ ও ১০০০০০ থেকে ১৫০০০০ চিত্রা হরিণ রয়েছে এখন সুন্দরবন এলাকায়। ১৯৯২ সালের ২১ মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবনে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক ঘুরতে আসে। প্রতি বছর দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ করার মাধ্যমে প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন জ্ঞান অর্জন করে।