ঢাকা নগর জাদুঘর ঢাকা সিটি করপোরেশন নিয়ন্ত্রিত একটি প্রতিষ্ঠান। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কার্যালয়ের নগর ভবনে এটি অবস্থিত। ঢাকার ইতিহাসকে সংরক্ষণের জন্য এই ভবনের ষষ্ঠতলায় জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ঢাকা শহরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্মৃতি সংরক্ষণ ও নগর বিষয়ক গবেষণার জন্য ১৯৮৭ সালের ২০ জুন রাজধানীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে 'ঢাকা নগর জাদুঘর'। এটি ঢাকা নগরী সম্পর্কিত জাদুঘর।
একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর আবির্ভাব ঘটে। ১৯৮৭ সালে ঢাকার ১৩৩, গ্রিন রোডের 'জাহানারা গার্ডেন' ছিল বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত নগর জাদুঘরের প্রথম অস্থায়ী কার্যালয়। তবে পুরান ঢাকার পাঁচ ভাই ঘাট লেনের একটি বাড়িতে প্রথম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল জাদুঘরটি। পরে জাদুঘরটি আরও কয়েকটি জায়গায় স্থানান্তরিত হয়। কয়েক বছর পরিচালনার পর জাদুঘরটি অধিগ্রহণে সিটি করপোরেশন আগ্রহী হলে তা ১৯৯৬ সালের ২০ জুলাই করপোরেশনকে হস্তান্তর করা হয়। নগর ভবনের ষষ্ঠতলার একটি সুপরিসর হলঘরে এটা স্থান লাভ করে। বর্তমানে এটা সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
এর প্রধান উদ্যোক্তা ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন। অন্যান্য উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন ইতিহাসবিদ সিরাজুল ইসলাম, নগরবিশারদ নজরুল ইসলাম, স্থপতি রবিউল হুসাইন ও শিল্পী হাশেম খান। এর ট্রাস্টি বোর্ডের প্রথম সভাপতি সিরাজুল ইসলাম ও প্রথম সাধারণ সম্পাদক মুনতাসীর মামুন। সিটি করপোরেশনের নিকট হস্তান্তর কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এখানে সংরক্ষিত আছে ঢাকা নগরীর স্মৃতি সংক্রান্ত জানা-অজানা নানা বিষয়। ১০০ বছর আগের ঢাকার মানচিত্রটি ছাড়াও এখানে আছে প্রাক-মোগল আমল থেকে বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত ঢাকার সীমানার ধারাবাহিক বৃদ্ধির নকশা। ঢাকার ইতিহাস সংবলিত ১০১টি দুর্লভ আলোকচিত্র রয়েছে এই নগর জাদুঘরে। এ ছাড়াও এই জাদুঘরে ঢাকার প্রথম ছাপাখানা ও নবাবি আমলের হুক্কা, উনিশ শতকে ঢাকার নবাবদের ব্যবহৃত পানের বাটা, সে আমলের মুদ্রা, পানদানি, তামার বালতি, জগ, ড্রেসিং টেবিল, শাঁখা ও শাঁখা তৈরির করাত, বদনাসহ নানা উপকরণ রয়েছে। দুর্লভ আলোকচিত্রের মধ্যে আছে- পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেন, রূপলাল হাউস, হোসেনি দালানের আদি রূপ, বড় কাটরা, ছোট কাটরা, সাতগম্বুজ মসজিদ, উনিশ শতকে নির্মিত বিভিন্ন বাড়ি, সেন্ট জেমস গির্জা (বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে), পুরনো হাইকোর্ট ভবন, ১৯০৪ সালে দিলকুশার নবাববাড়ি, ডানা দীঘি প্রভৃতি।
নগর জাদুঘর স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি বিষয়ক উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক নিদর্শনাদি সংগৃহীত হয়েছে। ইতোমধ্যেই নগর জাদুঘর ঢাকা শহরের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনার ওপর কার্ড, পোস্টার, পুস্তিকা এবং ঢাকা সংক্রান্ত নানা বিষয়ের ১৩টি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এগুলির মধ্যে মোহাম্মদ আবদুল কাইউমের চকবাজারের কেতাবপট্টি, শামসুর রাহমানের স্মৃতির শহর, আবদুল করিম এর ঢাকাই মসলিন, মুনতাসীর মামুনের ঢাকার হারিয়ে যাওয়া কামান, প্যাট্রিক গ্যাড্রেসের ঢাকা নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা ইত্যাদি উলেস্নখযোগ্য। এছাড়া প্রায়ই আলোকচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে ঢাকা নগরের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাবলি নগরবাসীর সামনে তুলে ধরা হয়।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম ইংরেজি সংবাদপত্র সাপ্তাহিক 'ঢাকা নিউজ' মুদ্রণ কাজে ব্যবহৃত মুদ্রণ যন্ত্রটি রয়েছে এই জাদুঘরে। এই মুদ্রণ যন্ত্রটি উনিশ শতকের (১৮৪৭-৪৮) মাঝামাঝি সময়ের। সেই সময় এই মুদ্রণ যন্ত্রটি স্থাপন করেছিলেন সুইজারল্যান্ডের স্যামুয়েল বোস্ট। পুরান ঢাকার একটি জীর্ণ বাড়ি থেকে ১৯৮৯ সালে ঢাকা নগর জাদুঘরের ট্রাস্টি হাশেম শফি এই মুদ্রণ যন্ত্রটি এখানে সংরক্ষণ করেছিলেন।
এখানে রয়েছে মোগল এবং ব্রিটিশ আমলের বিভিন্ন দলিল, ছবি এবং গ্রন্থসহ নানা জিনিস। ঢাকার ১৯৫২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ ও ১৯৭১ সালসহ নানা আন্দোলনের বেশকিছু দুর্লভ আলোকচিত্র ও পোস্টার রয়েছে।
ঢাকা নগরীর ঘটনাবহুল ইতিহাস ও শিল্পসামগ্রীর পরিচয়কে বিভিন্ন বস্তুগত নিদর্শনের মাধ্যমে জনসম্মুখে তুলে ধরা;
নাগরিকদের মধ্যে ঐতিহ্য চেতনা সৃষ্টি করা;
ঢাকা নগরীর বিভিন্ন সমস্যার উপর আলোকপাত করে নগরবাসীকে সচেতন করে তোলা এবং
ঢাকা নগরসংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দলিল-দস্তাবেজ সংরক্ষণ করা ইত্যাদি নানামুখী উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে নগর জাদুঘর যাত্রা শুরু করে।
নানা ঐতিহাসিক স্থাপনার ওপর কার্ড, পোস্টার, পুস্তিকা এবং ঢাকার বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেছে জাদুঘরটি। উলেস্নখযোগ্য হলো- শামসুর রাহমানের 'স্মৃতির শহর', আবদুল কাইউমের 'চকবাজারের কেতাবপঞ্জি', আবদুল করিমের 'ঢাকাই মসলিন', মুনতাসীর মামুনের 'ঢাকার হারিয়ে যাওয়া কামান', প্যাকি গ্যাডেসের 'ঢাকা নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা'।