বঙ্গভবন
ইতিহাস ও ঐতিহ্য
প্রকাশ | ১৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
বঙ্গভবন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন ও কার্যালয়। স্থাপনাটি দেশের রাজধানী ঢাকার দিলকুশা এলাকায় অবস্থিত। গোড়ার দিকে প্রাসাদটি মূলত ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয়ের অস্থায়ী বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পরে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত স্থাপনাটি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তখন এই ভবন গভর্নর হাউস নামে পরিচিত ছিল।
বঙ্গভবনের বর্তমান স্থানটির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বাংলার সালতানাতের আমলে বঙ্গভবন যে স্থানে তা ছিল হজরত শাহজালাল দাখিনি নামক ঢাকার এক সুফিসাধকের। সুলতানি আমলে সুফিসাধক হজরত শাহজালাল দখিনি এই এলাকায় বাস করতেন। তিনি ও তার অনুসারীরা তৎকালীন সুলতানের লোকজন কর্তৃক নির্মমভাবে নিহত (৮৮১ হিজরি) হলে এখানেই তাদের কবর দেওয়া হয়। স্থানটি জলদি সাধকের ভক্তদের মধ্যে একসময় মাজার হিসেবে পরিচিত লাভ করতে থাকে।
মুগল শাসনামলে মির্জা মুকিম সুবাহদার মীরজুমলার অধীনে নওয়ারা মহলের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। পুরানা পল্টন ময়দানের দক্ষিণ পাশে ছিল তার বাসভবন।
বঙ্গভবন এলাকায় মানুক হাউস নামে একটি ইমারত ছিল। জনশ্রম্নতি আছে, ব্রিটিশ রাজত্বের সময় মানুক নামের একজন আর্মেনীয় জমিদারের বাসস্থান ছিল এখানে। ঢাকার নবাব খাজা আবদুল গনি মানুকের কাছ থেকে স্থানটি কিনে নেন এবং এখানে একটি বাংলো তৈরি করেন, যার নাম দেওয়া হয় দিলকুশা বাগ।
এই বাসস্থলের ভেতর ও বাইরের অংশে দুটি বড় টিলা ছিল। একটি টিলা এখনো বঙ্গভবনের চৌহদ্দির মধ্যে রয়েছে। অভ্যন্তর ভাগে অবস্থিত বিশাল পুকুরটি মতিঝিল (মোতির পুকুর) নামে পরিচিত ছিল। মুগল শাসনের শেষের দিকে সম্ভবত এলাকাটি পরিত্যক্ত হয়।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পরে পূর্ববঙ্গ এবং আসামের সরকার এ জায়গাটির একাংশ ক্রয় করে সেখানে ভারতের ভাইসরয়ের জন্য একটি ভবন নির্মাণ করে, যা ১৯১১ সাল পর্যন্ত ভারতের গভর্নর জেনারেলের অস্থায়ী বাসস্থান হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়।
পূর্ববাংলায় তার সফর ও অবস্থানকালে ভাইসরয় এখানেই বাস করতেন। ১৯১১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রাসাদটিকে গভর্নর হাউস নামে ডাকা হতো এবং বাংলার গভর্নরের অস্থায়ী বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ভারত বিভাগের পরে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্ম হয় এবং প্রাসাদটি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বাসভবনে পরিণত হয়। ভবনটি ১৯৬১ সালে ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে এটি পুননির্মাণ করা হয়। ১৯৬৪ সালে ভবনটি পুনঃনির্মাণ শেষ হয়।
১৯৬৪ সালে নতুন ভবনের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এখানে বসবাস করতেন।
ব্রিটিশ আমলে ঢাকায় স্থাপিত অন্যান্য স্থাপত্যের মতো বঙ্গভবনও অনেকটা ভিক্টোরিয়া স্থাপত্যে নির্মিত। ১৯৬১ এবং ১৯৬৪ সালে সংস্কারের পর এখানে ইসলামি স্থাপত্য ও বাঙালি স্থাপত্যের সমন্বয় ঘটানো হয়।
চার দিকে লম্বা প্রাচীর ঘেরা মূলভবন ত্রিতল। প্রাসাদোপম চত্বরের চারপাশে সবুজ এবং বৃক্ষরাজি দ্বারা আবৃত। নিচতলার মেঝের চত্বরের ক্ষেত্রফল ৬৭০০ বর্গমিটার। উত্তর-পূর্ব কোণের দুটি তলাজুড়ে রয়েছে রাষ্ট্রপতির আবাসস্থল। পাঁচটি সুসজ্জিত প্রশস্ত শয়নকক্ষসহ রাষ্ট্রপতির জন্য দুটি সু্যট রয়েছে। এর দ্বিতীয় তলায় পাঁচটি সুদৃশ্য শয়নকক্ষ রয়েছে।
রাষ্ট্রপতির দপ্তর, সামরিক ও বেসামরিক সচিবালয়, অন্যান্য কর্মকর্তা এবং দেশি ও বিদেশি দর্শকদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কক্ষগুলো নিচতলায় অবস্থিত।
এসব ছাড়াও সেখানে রয়েছে কেবিনেট কক্ষ, অনুষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট হলঘর, দরবার কক্ষ, রাষ্ট্রীয় ভোজসভার জন্য নির্ধারিত হল, ছোট আকারের মিলনায়তন এবং স্থানীয় দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্রাম কক্ষ। রাষ্ট্রপতির আবাসস্থল ছাড়াও দ্বিতীয় তলায় রয়েছে কর্মকর্তাদের জন্য পাঁচটি কক্ষ, একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ এবং একটি স্টুডিও। বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানদের জন্য তিন তলায় রয়েছে চারটি সু্যট।
বঙ্গভবনে রয়েছে ৪৭ একরের খোলা জায়গা, এখানে নিরাপত্তা-অফিস, ডাকঘর, ব্যাংক, ক্যান্টিন, দর্জির দোকান, একটি তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ, রাষ্ট্রপতি নিরাপত্তা রেজিমেন্টের জন্য একটি ব্যারাক রয়েছে, যা বঙ্গভবনের প্রধান ফটকের কাছাকাছি অবস্থিত। বঙ্গভবনের কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের জন্য থাকার কোয়ার্টার রয়েছে বঙ্গভবনের আলাদা তিনটি স্থানে। এখানে সামরিক সচিব এবং সহকারী সামরিক সচিবের জন্য রয়েছে আরও দুটি বাংলো। রাতের বেলায় বঙ্গভবনের সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে ১৯৭২ সালের জানুয়ারির ১২ তারিখে গভর্নর হাউসের নাম পরিবর্তন করে বঙ্গভবন করা হয়। ওই দিনই আবু সাইদ চৌধুরী বাংলাদেশের প্রথম সাংবিধানিক রাষ্ট্রপতি হন এবং এ স্থানকে রাষ্ট্রপতির বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনামলেও ভবনটি রাষ্ট্রপতির বাসভবন ছিল।
বঙ্গভবন বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা। বঙ্গভবন যেহেতু রাষ্ট্রপতির বাসভবন সেহেতু এটি যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনের সমমর্যাদা বহন করে। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে এর পরিচর্যা করা হয়। কারণ এটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা এবং এ সময় এটি জনসংযোগ মাধ্যমগুলো ও পর্যটকদের মধ্যমণিতে পরিণত হয়। স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবসে এখানে বিশেষ অনুষ্ঠান হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির এ প্রাসাদে বসবাস এবং কাজ করে থাকেন এবং এখানে প্রায়ই বিভিন্ন সভা, সম্মেলন এবং রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং বৈদেশিক কূটনীতিকদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভোজের আয়োজন করা হয়।