ইতিহাস ও ঐতিহ্য

বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর

প্রকাশ | ১৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
রাজশাহী শহরের কেন্দ্রস্থল হেতেম খাঁ-তে অবস্থিত বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর হলো বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর। এটি প্রত্ন সংগ্রহে সমৃদ্ধ। প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহের তালিকায় বরেন্দ্র জাদুঘর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম। এই প্রত্ন সংগ্রহশালাটি ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছিল। বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এটি পরিচালনা করে থাকে। বরেন্দ্র জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় নাটোরের দিঘাপাতিয়া রাজপরিবারের জমিদার শরৎ কুমার রায়, আইনজীবী অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রামপ্রসাদ চন্দ্রের উলেস্নখযোগ্য অবদান রয়েছে। ১৯১০ সালে তারা বাংলার ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের জন্য বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি গঠন করে। বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালিয়ে ৩২টি দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন সংগ্রহ করেন। এই নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করার জন্য শরৎ কুমার রায়ের দান করা জমিতে জাদুঘরটির নিজস্ব ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। নির্মাণ শেষ হয় ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯১৩ সালে ১৩ নভেম্বর বাংলার তৎকালীন গভর্নর কারমাইকেল জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন। অবশেষে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর নিজস্ব ভবনে যাত্রা শুরু করে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পরে জাদুঘরটির অস্তিত্ব্ব নিয়ে সংকট দেখা দেয়। ১৯৪৯ থেকে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জাদুঘর ভবনটির অর্ধেকাংশ মেডিকেল স্কুল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে জাদুঘরটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে ওই বছরের ১০ অক্টোবর তারিখে এর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধিগ্রহণ করে। জাদুঘরটির পরিদর্শকদের মধ্যে রয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিরা। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে প্রত্নস্থল আবিষ্কারের লক্ষ্যে শরৎকুমার ১৯১০ সালের এপ্রিলে দেওপাড়া, পালপাড়া, মালঞ্চ, জগপুর, ইটাহার, চব্বিশনগর, মান্দইল, কুমারপুর, খেতুর ও বিজয়নগর পরিদর্শন করেন। তারা মান্দইল থেকে চন্ডীর কয়েকটি প্রমাণসাইজ মূর্তিসহ প্রায় ৩২টি ভাস্কর্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। রাজশাহীতে ফিরে আসার পর শহরের গণ্যমান্য নাগরিকগণ শরৎকুমার ও তার সহকর্মীদের সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন এবং রাজশাহীতে প্রত্নসামগ্রী সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। সুতরাং প্রয়োজনের তাগিদে রাজশাহী জাদুঘর (পরবর্তীকালে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর) গড়ে ওঠে এবং প্রত্নসামগ্রী সংরক্ষণের জন্য শরৎকুমার মাসে ২০০ টাকা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। বরেন্দ্র জাদুঘরের সংগ্রহ সংখ্যা ৯ হাজারেরও অধিক। এখানে হাজার বছর আগের সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন রয়েছে। মহেঞ্জোদারো সভ্যতা থেকে সংগৃহীত প্রত্নতত্ত্ব, পাথরের মূর্তি, খ্রিস্টীয় একাদশ শতকে নির্মিত বুদ্ধ মূর্তি, ভৈরবের মাথা, গঙ্গা মূর্তিসহ অসংখ্য মূর্তি এই জাদুঘরের অমূল্য সংগ্রহের অন্তর্ভুক্ত। মোগল আমলের রৌপ্র মুদ্রা, গুপ্ত সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের গোলাকার স্বর্ণমুদ্রা, সম্রাট শাহজাহানের গোলাকার রৌপ্য মুদ্রা বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য। এখানে প্রায় ৫,০০০ পুঁথি রয়েছে যার মধ্যে ৩৬৪৬টি সংস্কৃত আর বাকিগুলো বাংলায় রচিত। পাল যুগ থেকে মুসলিম যুগ পর্যন্ত সময় পরিধিতে অঙ্কিত চিত্রকর্ম, নূরজাহানের পিতা ইমাদ উদ দৌলার অঙ্কিত চিত্র এখানে রয়েছে। ভাস্কর্য, খোদিত লিপি, পান্ডুলিপি, মুদ্রা এবং অন্যান্য মূল্যবান প্রত্নসম্পদ সংগ্রহের জন্য শরৎকুমার ও তার সহযোগীরা বাংলার বিভিন্ন জেলায় অনুসন্ধান চালান। তারা বেশ কিছু প্রত্নসম্পদ আবিষ্কার, শনাক্ত ও সংগ্রহ করেন। সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সোসাইটি দেওপাড়ায় প্রদু্যম্নেশ্বর দীঘি খনন করে এবং এর ভেতর থেকে ৬৪টি ভাস্কর্য এবং তিনটি পোড়ামাটির মনসা-ঘট উদ্ধার করে। ১৯১১ সালে সোসাইটির কয়েকজন সদস্য পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাট থেকে ৫ মাইল দূরবর্তী কোসীপুর ঢিবি খনন করে ইটের তৈরি দেয়াল, ঢিবিমুখী একটি ইটের রাস্তা এবং কয়েকটি ভাস্কর্য উন্মুক্ত করেন। ১৯১৬ সালের নভেম্বরে সোসাইটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ মাহীসন্তোষ এবং রাজশাহী জেলার কুমারপুর প্রত্নস্থলে খনন কাজ চালিয়ে প্রচুর প্রত্নসম্পদ সংগ্রহ করেন। ১৯৩৭ সালের ৬ নভেম্বরের এক সরকারি প্রজ্ঞাপন মোতাবেক প্রতিষ্ঠিত ম্যানেজমেন্ট কমিটির নিকট বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি বর্তমান বিল্ডিং-এর ওপর এর স্বত্বাধিকার, সব প্রত্নসংগ্রহ, ছাপানো বই ও পান্ডুলিপি এবং আসবাবপত্র তুলে দেয়। তালিকায় অন্তর্গত ছিল ৭৬০টি প্রস্তর ভাস্কর্য, ৪৭টি ধাতুনির্মিত ভাস্কর্য, ২টি কাঠের ভাস্কর্য, ৪টি মৃন্ময় ভাস্কর্য, ৪টি কামান, ২১১টি অলঙ্কৃত ইট, ৪২টি পোড়ামাটির ফলক, ২৯টি চকচকে টালি, ১৭টি প্রস্তরলিপি, ২৩টি পোড়ামাটির লিপি, ৪টি দলিল (কাগজ), ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে ব্যবহৃত ১১১টি পাত্র (ধাতু নির্মিত), ১০টি গহনা, ৪৩৪টি স্বর্ণমুদ্রা এবং ৪টি পোশাক-পরিচ্ছেদ। এছাড়া সোসাইটি ১৮৩২টি বই এবং ২৫৩০টি সংস্কৃত ও ১২২৩টি বাংলা পান্ডুলিপি কমিটির হাতে তুলে দেয়। জাদুঘর এনডাউমেন্ট ও প্রকাশনা তহবিল এবং সবিতা রায় স্মৃতি তহবিল (সংস্কৃত গ্রন্থ প্রকাশের জন্য শরৎকুমার রায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত) জাদুঘরের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়। ১৯২৩ সালে প্রাদেশিক সরকারের যে অনুদান জাদুঘরের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল তা আবার শুরু হয়, অবশ্য ২০% হ্রাসকৃত হারে। প্রকাশনা ও খননকাজের ব্যয়ের নিমিত্তে সরকারি অনুদানের পরিপূরক হিসেবে শরৎকুমার উদারভাবে অর্থ দান করেন। ১৯৩০ সালে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং ১৯৪৫ সালে শরৎ কুমার রায়ের মৃতু্যর ফলে জাদুঘরের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ জাদুঘরের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে। ১৯৪৯ সালে জাদুঘরটিকে মেডিকেল স্কুলে রূপান্তর করা হয়। ১৯৬১ সাল পর্যন্ত জাদুঘরের উত্তরাংশ স্কুলের দখলে ছিল। এই জাদুঘরটি বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাদুঘর। এটি বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটির একটি বড় অর্জন। শরৎকুমার রায় এবং তার সহযোগী অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, রমাপ্রসাদ চন্দ প্রমুখ প্রত্ন-অনুরাগী এই প্রতিষ্ঠান দুটি গড়ে তোলার জন্য তারা তাদের সময় ও শ্রম ব্যয় করেন। তাদের সারা জীবনের প্রয়াস ছিল ওই সময়ের টিকে থাকা অমূল্য প্রত্নসম্পদ (বাংলার, বিশেষ করে বরেন্দ্রীর) জনসম্মুখে প্রকাশ করা।