জাতীয় জাদুঘর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জাদুঘর ও সংগ্রহশালা। জাদুঘরটি শাহবাগ মোড়ের সন্নিকটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃ-তাত্ত্বিক, শিল্পকলা ও প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কিত নিদর্শনাদি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান।
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯১৩ সালে ঢাকা জাদুঘর নামে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২০ মার্চ এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করা হয়। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর তারিখে এটিকে জাতীয় জাদুঘরের মর্যাদা দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর স্থাপনার নকশা করেছেন দেশের প্রখ্যাত স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন।
বর্তমানে রাজধানী ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র শাহবাগে ৮.৬৩ একর জমির ওপর একটি চারতলা ভবনে জাদুঘরটি অবস্থিত। এ জাদুঘরে ৪৪টি প্রদর্শনী কক্ষ, তিনটি অডিটরিয়াম, একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ও দুটি অস্থায়ী প্রদর্শনী কক্ষ রয়েছে। এছাড়া জাতীয় জাদুঘরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে চারটি শাখা জাদুঘর। এগুলো হলো সিলেটের ওসমানী জাদুঘর, ঢাকার আহসান মঞ্জিল জাদুঘর, চট্টগ্রামের জিয়া স্মৃতি জাদুঘর এবং ময়মনসিংহের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা।
এখানে নৃতত্ত্ব, চারুকলা, ইতিহাস, প্রকৃতি এবং আধুনিক ও প্রাচীন বিশ্বসভ্যতা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ে আলাদা ৪৫টি প্রদর্শনশালা (গ্যালারি) রয়েছে। এছাড়া এখানে একটি সংরক্ষণাগার, গ্রন্থাগার, মিলনায়তন, সিনেপেস্নক্স এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনালয় রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৫৬ সালে দি ঢাকা নিউজ পত্রিকায় প্রথম ঢাকায় একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উলেস্নখ করে সংবাদ প্রকাশিত হয়। কিন্তু উনিশ শতকে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ অপ্রত্যাশিতভাবে ঢাকায় জাদুঘর স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি করে। ঢাকাকে লর্ড কার্জনের পরিকল্পনা অনুসারে গঠিত নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী করা হলে শিলং কেবিনেটের মুদ্রাসমূহ ঢাকায় স্থানান্তরের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই সুযোগে সরকারি মুদ্রা বিশারদ এইচ ই স্টেপলটন ঢাকায় একটি জাদুঘর স্থাপনের জন্য জনশিক্ষা পরিচালকের কাছে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯০৯ সালে স্টেপলটনের প্রস্তাব সরকারি পর্যায়ে আলোচিত হলে গভর্নর স্যার ল্যান্সলট হেয়ার প্রস্তাবিত জাদুঘরের জন্য একটি স্থান নির্বাচনের নির্দেশ দেন। তবে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত হওয়ায় সরকারি উদ্যোগে ঢাকায় জাদুঘর স্থাপনের প্রচেষ্টা থেমে যায়। এই অবস্থায় ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিকরা জাদুঘর প্রতিষ্ঠার জন্য সোচ্চার হন।
বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড কারমাইকেলের ঢাকায় আগমন উপলক্ষে ১৯১২ সালের ২৫ জুলাই নর্থবস্নক হলে তাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই অনুষ্ঠানে ঢাকার বিশিষ্ট নাগরিকরা এখানে একটি জাদুঘর স্থাপনের দাবি জানান। এ দাবির সপক্ষে অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের আয়োজিত প্রদর্শনী দেখে মুগ্ধ হয়ে লর্ড কারমাইকেল জাদুঘর প্রতিষ্ঠার জন্য ২,০০০ রুপি মঞ্জুর করেন। ১৯১৩ সালের ৫ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে জাদুঘর স্থাপনের সরকারি অনুমোদন গেজেট আকারে প্রকাশিত হয় এবং ৩০ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রভিশনাল জেনারেল কমিটি গঠন করা হয়। ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার নিকোলাস ডি বিটসন বেল কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। এই কমিটিকে জাদুঘরের খসড়া নীতিমালা প্রণয়নের জন্য সাময়িক নির্বাহী কমিটি গঠনের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। ওই বছরের ৭ আগস্ট লর্ড কারমাইকেল ঢাকা জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ১৮ নভেম্বর বেঙ্গল গভর্নমেন্ট সাময়িক নির্বাহী কমিটি কর্তৃক প্রণীত খসড়া জাদুঘর নীতিমালা অনুমোদন করে। এই নীতিমালা অনুযায়ী সাধারণ পরিষদ ও নির্বাহী পরিষদ গঠন করা হয়। ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার এফ সি ফ্রেঞ্চ দুই পরিষদেরই সভাপতি নিযুক্ত হন, স্টেপলটনকে নিয়োগ করা হয় সম্পাদক। ১৯১৪ সালের ৬ জুলাই নলিনীকান্ত ভট্টশালীকে জাদুঘরের কিউরেটর নিযুক্ত করা হয়। ড. এন গুপ্তকে প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কিত নিদর্শন সংগ্রহ ও গ্যালারি উপস্থাপনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এছাড়া একজন চাপরাশি, একজন বেয়ারা ও একজন দারোয়ান নিয়োগ দেওয়া হয়।
১৯১৪ সালের ২৫ আগস্ট ঢাকা জাদুঘর সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। তখন জাদুঘরের মোট নিদর্শনের সংখ্যা ছিল ৩৭৯টি।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংগৃহীত নিদর্শনের সংখ্যা প্রায় ৯৪ হাজার। প্রতিটি নিদর্শনের একটি একসেশন নম্বর আছে। নিদর্শনের নাম, সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও ফটো নিয়ে কম্পিউটার ডাটাবেইজ প্রণয়ন করা হয়েছে। ৭৫০০ নিদর্শনের বর্ণনামূলক ক্যাটালগ প্রণয়ন ও প্রকাশ করা হয়েছে।
সংগৃহীত নিদর্শনসমূহের প্রায় ৫ হাজার নিদর্শন ৪৫টি প্রদর্শন কক্ষে জনসাধারণের দর্শনের জন্য সাজিয়ে রাখা আছে। ৩৮ নম্বর প্রদর্শন কক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র প্রদর্শনী প্রকোষ্ঠ করা হয়েছে। এছাড়া আইএফআইসি ব্যাংক ও দৃকের সহায়তায় ৩৫ নম্বর গ্যালারিতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন চিত্রশালা স্থাপন করা হয়েছে। ২৬ নম্বর কক্ষটি "সাহিত্য গ্যালারি" হলেও এতে দর্শনার্থীদের জন্য বিভিন্ন নাগরিকসেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।