ইতিহাস ও ঐতিহ্য
ঢাকেশ্বরী মন্দির
প্রকাশ | ০৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
ঢাকেশ্বরী মন্দির বা ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির ঢাকায় অবস্থিত একটি মন্দির। এই মন্দিরটিকে বাংলাদেশের জাতীয় মন্দিরও বলা হয়। এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি ঐতিহাসিক পুণ্যস্থান। ঢাকেশ্বরী শব্দের আক্ষরিক অর্থ 'ঢাকার ঈশ্বরী' বা 'ঢাকা শহরের রক্ষাকর্ত্রী'। সলিমুলস্নাহ হল থেকে আনুমানিক ১.৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ঢাকেশ্বরী রোডের উত্তর পার্শ্বে একটি অনুচ্চ আবেষ্টনী প্রাচীরের মধ্যে মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দির অঙ্গনে প্রবেশের জন্য রয়েছে একটি সিংহদ্বার। সিংহদ্বারটি নহবতখানা তোরণ নামে অভিহিত। এই মন্দিরটি ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত শক্তিপীঠগুলোর একটি। এখানে সতীর মুকুটের মণি পড়েছিল। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম মন্দির। অনেকের মতে, দেবী ঢাকেশ্বরীর নাম থেকেই ঢাকা নামের উৎপত্তি।
জনশ্রম্নতি অনুযায়ী, সেন রাজবংশের রাজা বলস্নাল সেন দ্বাদশ শতাব্দীতে এটি প্রতিষ্ঠা করেন।
কেউ কেউ দাবি করেন যে, এখানে প্রতিষ্ঠিত ঢাকেশ্বরী মূর্তি ও মন্দির মহারাজা বলস্নাল সেনের আমলের। কিন্তু স্থাপত্য নির্মাণ কৌশলের বিবেচনায় এটি গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমনের পূর্বে তথা সেন রাজবংশের রাজত্বকালে বাংলার স্থাপত্যশিল্পে মর্টার হিসেবে চুন-বালি মিশ্রণের ব্যবহার ছিল না। কিন্তু ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি আগাগোড়াই চুন-বালির গাঁথুনিতে নির্মিত, যা বাংলার মুসলিম আমলেরই স্থাপত্য রীতির বৈশিষ্ট্য।
ধারণা করা হয়, এটি ঢাকার আদি ও প্রথম মন্দির। ঢাকেশ্বরী দেবী ঢাকা অধিষ্ঠাত্রী বা পৃষ্ঠপোষক দেবী। কিংবদন্তি অনুযায়ী, রাজা আদিসুর তার এক রানীকে বুড়িগঙ্গার এক জঙ্গলে নির্বাসন দেয়। জঙ্গলে রানী প্রসব করে পুত্র বলস্নাল সেনকে। জঙ্গলেই বেড়ে ওঠেন বলস্নাল সেন। শৈশবে জঙ্গলের মধ্যে বলস্নাল সেন একটি দেবীমূর্তি পান (মতান্তরে, রাজ ক্ষমতায় বসার পর এই জঙ্গলে তিনি মূর্তিটি পান)। বলস্নাল সেন বিশ্বাস করতে শুরু করেন জঙ্গলে সব বিপদ-আপদ থেকে এই দেবী দুর্গাই তাকে রক্ষা করেছেন। পরে বলস্নাল সেন রাজ ক্ষমতায় আসীন হলে তার জন্মস্থানে যেখানে দেবীর মূর্তি পেয়েছিলেন সেখানে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মূর্তিটি জঙ্গলে ঢাকা অবস্থায় পেয়েছিলেন যার ফলে দেবীর নাম হয় 'ঢাকা+ঈশ্বরী' বা 'ঢাকেশ্বরী'। মন্দিরটিও 'ঢাকেশ্বরী মন্দির' নামে পরিচিতি পায়।
কথিত আছে, রানী, রাজা বিজয় সেনের স্ত্রী স্নান করার জন্য লাঙ্গলবন্দ গিয়েছিলেন। ফিরে আসার সময় তিনি একটি পুত্রকে জন্ম দেন, যিনি বলস্নাল সেন বলে পরিচিত হন। সিংহাসনে উঠার পর, বলস্নাল সেন তার জন্মস্থানকে মহিমান্বিত করার জন্য এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। কথিত আছে যে বলস্নাল সেন একবার জঙ্গলে আচ্ছাদিত দেবতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বলস্নাল সেন সেখানে দেবীকে আবিষ্কৃত করেন এবং একটি মন্দির নির্মাণ করান, মূর্তিটি ঢাকা ছিল বলে ঢাকেশ্বরী নামকরণ হয়।
এই মন্দিরের দেবী ঢাকেশ্বরীর ৮০০ বছরের পুরনো আসল বিগ্রহটি কলকাতার কুমারটুলি অঞ্চলে দুর্গাচারণ স্ট্রিটের শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী মাতার মন্দিরে রয়েছে। দেশ ভাগের সময় ঢাকা থেকে কলকাতায় এটিকে আনা হয়। দেশভাগ-পরবর্তী দাঙ্গার সময় সম্ভাব্য আক্রমণ এবং লুণ্ঠনের হাত থেকে দেবীকে রক্ষা করতে ঢাকার মূল বিগ্রহটিকে গোপনে এবং দ্রম্নততার সঙ্গে ১৯৪৮-এ কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন রাজেন্দ্র কিশোর তিওয়ারি (মতান্তরে প্রহ্লাদ কিশোর তিওয়ারি) এবং হরিহর চক্রবর্তী। বিশেষ একটি বিমানে ঢাকেশ্বরী আসল বিগ্রহটি কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল। কলকাতায় বিগ্রহটি আনার পর প্রথম দু'বছর হরচন্দ্র মলিস্নক স্ট্রিটে দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরির বাড়িতে দেবী পূজিতা হন। পরে ১৯৫০ নাগাদ ব্যবসায়ী দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরী কুমারটুলি অঞ্চলে দেবীর মন্দির নির্মাণ করে দেন ও প্রতিষ্ঠা করে দেবীর নিত্য সেবার জন্য কিছু দেবোত্তর সম্পত্তি দান করেছিলেন। মূল দেবী বিগ্রহের উচ্চতা দেড় ফুটের মতো, দেবীর দশ হাত, কাত্যায়নী মহিসাসুরমর্দিনী দুর্গা রূপেই তিনি অবস্থান করছেন। পাশে লক্ষ্ণী, সরস্বতী ও নিচে কার্তিক ও গণেশ। বাহন রূপে পশুরাজ সিংহ দন্ডায়মান যার ওপর দাঁড়িয়ে দেবী মহিসাসুরকে বধ করেছেন। মানসিংহ এই বিগ্রহ ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করে আজমগড়ের এক তিওয়ারি পরিবারকে সেবায়েত নিযুক্ত করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে সেই পরিবারের বংশধরেরাই কলকাতায় এসে পুনরায় সেবায়েত নিযুক্ত হন, এখনো তারাই দেবীর নিত্য সেবা করেন।
বর্তমানে ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে থাকা বিগ্রহটি মূল মূর্তির প্রতিরূপ। এখানে প্রতি বছর ধুমধামের সঙ্গে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়।
মন্দির কমপেস্নক্সটির দীর্ঘ অস্তিত্বকালে পুনর্নির্মাণ ও সংস্কারের দরুন বর্তমানে এর আদি স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যের কোনো কিছুই স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় না।