ইতিহাস ও ঐতিহ্য
সাত গম্বুজ মসজিদ
প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত সাত গম্বুজ মসজিদ মুঘল শাসনামলে নির্মিত একটি ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। চারটি মিনারসহ তিনটি গম্বুজের কারণে মসজিদের নাম হয়েছে 'সাতগম্বুজ মসজিদ'। এই মসজিদটি মুঘল আমলের অন্যতম নিদর্শন।
মসজিদের ছাদে বড় ৩টি এবং চার কোণে অবস্থিত ৪টি মিনারের ওপর অনুগম্বুজসহ মোট সাতটি গম্বুজের কারণে মসজিদটি সহজেই সাত গম্বুজ মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে। মোগল সুবাদার শায়েস্তা খাঁর পুত্র উমিদ খাঁ ১৬৮০ সালে এই সাত গম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করেন। সাত গম্বুজ মসজিদের সঙ্গে লালবাগ দুর্গ মসজিদ এবং খাজা আম্বর মসজিদের অনেক মিল লক্ষ্য করা যায়।
২৬.৮২ মি. দ্ধ ২৫.৬০ মি. পরিমাপের সামান্য উঁচু পাকা একটি ভিতের পশ্চিম অংশ জুড়ে মসজিদটি স্থাপিত। এই ভিত্তিটি নিচু একটি প্রাচীর দ্বারা ঘেরা এবং পূর্ব প্রাচীরের মাঝ বরাবর একটি প্রবেশপথ রয়েছে। পাশের অলঙ্কৃত ছোট মিনারসহ এই খিলানপথটি মসজিদের কেন্দ্রীয় প্রবেশপথ বরাবর অবস্থিত। উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিক থেকে প্রবেশপথটির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে সিঁড়ি।
আয়তাকার মসজিদটির ভেতর দিকের পরিমাপ ১৪.৩৩ মি. দ্ধ ৪.৮৮ মি.। কোণের অষ্টভুজী বুরুজগুলোর ওপর স্থাপিত ফাঁপা গম্বুজ মসজিদটিকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করে তুলেছে। নামাজ কক্ষে প্রবেশের জন্য রয়েছে খিলানপথ- তিনটি পূর্ব দেওয়ালে এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে একটি করে। পূর্ব দেওয়ালের খিলানপথ বরাবর পশ্চিম দেওয়ালে রয়েছে তিনটি অর্ধ-অষ্টভুজাকার মিহরাব কুলুঙ্গি। কেন্দ্রীয় মিহরাবের পাশে তিন ধাপ বিশিষ্ট পাকা মিনার রয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাব ও খিলানপথ এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালের খিলানপথগুলো সম্মুখভাগে অভিক্ষিপ্ত ফ্রন্টনের মাঝে ন্যস্ত। ফ্রন্টনগুলো পাশে অলঙ্কৃত ছোট মিনার সমৃদ্ধ।
মসজিদ অভ্যন্তর প্রশস্ত দুটি খিলান দ্বারা তিন ভাগে বিভক্ত। মাঝের 'বে' টি বর্গাকার এবং পার্শ্ববর্তী আয়তাকার 'বে' দুটি অপেক্ষা বড়। মসজিদের ছাদ অষ্টভুজাকার ড্রামের উপর স্থাপিত সামান্য কন্দাকার তিনটি গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। গম্বুজগুলোর মধ্যে মাঝেরটি পার্শ্ববর্তী গম্বুজ দুটি অপেক্ষা বড়। প্রশস্ত দুটি খিলান এবং কেন্দ্রীয় মিহরাব ও খিলানপথের ওপর স্থাপিত বদ্ধ খিলান এবং এদের কোণের ত্রিকোনাকার পেন্ডেন্টিভের ওপর কেন্দ্রীয় গম্বুজটি স্থাপিত। তবে পাশের আয়তাকার স্থানের ওপর গম্বুজ স্থাপনে চাতুর্যময় কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। গম্বুজের বক্রাকার ভিত্তি নির্মাণের জন্য পূর্ব ও পশ্চিম দেওয়ালে অর্ধ-গম্বুজ ভল্ট তৈরি করে প্রথমে আয়তাকার স্থানটিকে বর্গাকারে রূপান্তর করা হয়েছে। এই অর্ধ-গম্বুজ ভল্টগুলোর সঙ্গে কোণের সারিবদ্ধ পেন্ডেন্টিভের ওপর ছোট গম্বুজগুলোর ভার ন্যস্ত করা হয়েছে।
মসজিদের অনুভূমিক প্যারাপেট এবং গম্বুজের ড্রাম সারিবদ্ধ মেরলোন নকশায় শোভিত। পূর্ব ফাসাদ প্রচলিত মুগল রীতির প্যানেল দ্বারা সজ্জিত। মিহরাবগুলোর সম্মুখভাগ মনোরমভাবে খাঁজকাটা। কেন্দ্রীয় মিহরাবকে বেষ্টনকারী আয়তাকার ফ্রেমটির উপরের দিকে রয়েছে বদ্ধ শিখরসদৃশ ফ্রিজ। সবগুলো গম্বুজের চূড়া কলস ও পদ্ম শীর্ষ সংবলিত এবং এদের অভ্যন্তরভাগের ভিত্তিপত্র নকশায় সজ্জিত। কেন্দ্রীয় গম্বুজের শীর্ষে রয়েছে পাঁচ স্তর বিশিষ্ট অলঙ্কৃত বিশাল মেডালিয়ন। উত্তর ভারতে অবস্থিত মুঘল রীতির অন্যান্য নমুনার মতো মসজিদটির কোনো প্রাচীর জাঁকজমকপূর্ণভাবে অলঙ্কৃত নয়, তবে তারপরও মসজিদটি তার বিভিন্ন অংশের জৌলুসময় সুবিন্যস্ততার জন্য আকর্ষণীয়।
মসজিদের শিলালিপিটি বর্তমানে অনুপস্থিত, তাই এটি নির্মাণের সঠিক সময় জানা যায় না। তবে গম্বুজ আচ্ছাদিত ফাঁপা ও বিশালাকার কর্নার টাওয়ার ব্যতীত এর পস্ন্যান ও অন্যান্য নির্মাণ শৈলী বিবেচনা করে মসজিদটিকে সতেরো শতকের শেষ দিকের ঢাকার বিভিন্ন মসজিদ, যেমন- লালবাগ দুর্গ মসজিদ (আনু. ১৬৭৮-৭৯) এবং খাজা আম্বর মসজিদের (১৬৮০) সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়। শৈলিগত দিক বিবেচনা করলে মসজিদটির নির্মাণকাল ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময় বলে মনে হয়।
ঢাকার খাজা শাহবাজ মসজিদ ও মুসা খান মসজিদের ন্যায় এ মসজিদের কর্নার টাওয়ারগুলোতে ছোট মিনার বিদ্যমান। দ্বিতল বুরুজগুলো নিজেরাই এক-একটি স্বতন্ত্র ভবনের মতো। নিচের তলায় উত্তর-দক্ষিণ এবং পূর্ব-পশ্চিম অক্ষে চারটি খিলানপথ রয়েছে। নিচতলার ছাদটি অভ্যন্তরভাগে গম্বুজাকার হলেও এর উপরের অংশ, অর্থাৎ দ্বিতীয় তলার মেঝেটি সমতল। বিস্তৃত পদ্মচূড়া শোভিত গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত দ্বিতীয় তলাটি সামান্য পার্থক্যসহ একেবারেই নিচতলার মতো। নিচতলার মতো চারদিকে চারটি খিলানপথ থাকলেও ছাদের দিকে আর একটি বাড়তি প্রবেশপথ রয়েছে। এই পথ দিয়ে মসজিদের ছাদ থেকে মিনারের উপরের তলে প্রবেশ করা যায়।
সাত গম্বুজ মসজিদের পূর্বে একটি সমাধি রয়েছে। ভেতর থেকে অষ্টকোণ এবং বাইরের দিকে চতুষ্কোণ বিশিষ্ট সমাধিটিকে অনেকে শায়েস্তা খাঁর মেয়ের সমাধি হিসেবে মনে করেন। বিবির মাজারখ্যাত সমাধিক্ষেত্রটি একসময় পরিত্যক্ত থাকলেও বর্তমানে এর সংস্কার করা হয়েছে।
এছাড়া মসজিদের কাছেই আছে একটি উদ্যান এবং জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা। এককালে বুড়িগঙ্গা নদীর ধারা সাত গম্বুজ মসজিদের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হলেও বর্তমানে চারপাশে বেশকিছু ছোট-বড় দালানকোঠা নির্মিত হয়েছে।