ইতিহাস ও ঐতিহ্য

উত্তরা গণভবন

প্রকাশ | ০৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
দিঘাপাতিয়া রাজবাড়ি বা উত্তরা গণভবন আঠারো শতকে নির্মিত দিঘাপাতিয়া মহারাজাদের বাসস্থান। এটি বাংলাদেশের নাটোর শহরে অবস্থিত। নাটোর শহর থেকে প্রায় ২.৪ কিমি দূরে প্রাসাদটির অবস্থান। ১৯৭২ সনের ৯ ফেব্রম্নয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিঘাপাতিয়া রাজবাড়িকে উত্তরা গণভবন নামকরণ করেন। নাটোরের বিখ্যাত দিঘাপাতিয়া রাজবাড়ি বর্তমানে উত্তরা গণভবন (টঃঃধৎধ এড়হড়াড়নড়হ) বা উত্তরাঞ্চলের গভর্মেন্ট হাউস নামে পরিচিত। নাটোরের রানী ভবানী তার নায়েব দয়ারাম রায়কে দিঘাপাতিয়া পরগনা উপহার দেন। পরবর্তীতে নায়েব সেখানে কয়েকটি প্রাসাদ গড়ে তোলেন। প্রায় ৪৩ একর আয়তনের লেক ও প্রাচীরবেষ্টিত রাজবাড়িটিতে মোট ১২টি ভবন রয়েছে। উত্তরা গণভবনের পিরামিড আকৃতির চারতলা প্রবেশদ্বারের চূড়ায় বিখ্যাত কোক অ্যান্ড টেলভি কোম্পানির তৈরি একটি ঘণ্টা ঘড়ি স্থাপন করা হয়েছে। আর মূল প্রাসাদভবনে প্রবেশ করলে রাজার সিংহাসন, আক্রমণ ঠেকানোর বর্ম এবং তলোয়ার দেখতে পাওয়া যায়। রাজপ্রাসাদের প্রাঙ্গণে ইতালি থেকে সংগৃহীত ভাস্কর্যে সুসজ্জিত বাগান রয়েছে। মনোমুগ্ধকর এই বাগানে স্থান পেয়েছে হাপরমালি, নীলমণিলতা, রাজ-অশোক, পারিজাত, কর্পূর, সৌরভী, হৈমন্তী, যষ্টিমধু, বনপুলক, পেয়ালি, সেঁউতি, তারাঝরা, সাইকাস, মাধবী ইত্যাদি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এছাড়া আছে রাজা প্রসন্ননাথের আবক্ষমূর্তি, জমিদার দয়ারামের ভাস্কর্য, চারটি কামান, কুমার ভবন, তহশিল অফিস ও অতিথিশালা। দিঘাপাতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা দয়ারাম রায় নাটোর রাজ্যের রাজা রামজীবনের দেওয়ান ছিলেন। তিনি (১৬৮০-১৭৬০) ১৭৩৪ সালে প্রায় ৪৩ একর জমির ওপর দিঘাপাতিয়া প্রাসাদের মূল অংশ ও এর সংলগ্ন কিছু ভবন নির্মাণ করেন। রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমোদনাথ রায়ের আমলে ১৮৯৭ সালের ১০ জুন নাটোরের ডোমপাড়া মাঠে তিন দিনব্যাপী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের এক অধিবেশন আয়োজন করেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এ অধিবেশনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন। তবে শেষ দিন ১৮৯৭ সালের ১২ জুন প্রায় ১৮ মিনিটব্যাপী এক প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে রাজপ্রাসাদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে রাজা প্রমোদনাথ রায় সম্পূর্ণ প্রাসাদ কমপেস্নক্সটি পুনর্র্নির্মাণ করেন। রাজা প্রমোদনাথ রায় চারদিকে সীমানা প্রাচীর দিয়ে রাজবাড়ির ভেতরে বিশেষ কারুকার্যচিত মূল ভবনসহ ছোট-বড় মোট ১২টি ভবন নির্মাণ করেন। তিনি ১৮৯৭ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ১১ বছর সময় ধরে বিদেশি বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও চিত্রকর আর দেশি মিস্ত্রিদের সহায়তায় সাড়ে ৪১ একর জমির ওপর এই রাজবাড়িটি পুনর্র্নির্মাণ করেন। তিনি মোগল ও প্রাশ্চাত্যরীতির মিশ্রণে কারুকার্যময় নান্দনিক এই ভবনটিকে এক বিরল রাজভবন হিসেবে গড়ে তোলেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর দিঘাপাতিয়া রাজা দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। ১৯৫০ সালে জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাস হওয়ার পর দিঘাপাতিয়ার রাজপ্রাসাদটির রক্ষণাবেক্ষণে বেশ সমস্যা দেখা দেয়। সমস্যা সমাধানে দিঘাপাতিয়ার মহারাজাদের এই বাসস্থানকে ১৯৬৭ সালের ২৪শে জুলাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান গভর্নরের বাসভবন হিসেবে উদ্বোধন করেন। পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালের ৯ই ফেব্রম্নয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে এর নাম পরিবর্তন করে উত্তরা গণভবন ঘোষণা করেন। তিনি ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রম্নয়ারি এই ভবনের মূল প্রাসাদের ভেতর মন্ত্রিসভার বৈঠক আহ্বান করেন। সেই থেকে ভবনটি 'উত্তরা গণভবনে'র প্রকৃত মর্যাদা লাভ করে। প্রাসাদের পিছন দিকে রয়েছে ফোয়ারাসহ একটি সুদৃশ্য বাগান। বাগানের এক কোণে রয়েছে প্রমাণ আকৃতির মার্বেল পাথরের তৈরী একটি নারীমূর্তি। দিঘাপাতিয়া রাজবাড়িতে প্রধান প্রাসাদ ভবন, কুমার প্রাসাদ, প্রধান কাচারি ভবন, ৩টি কর্তারানী বাড়ি, প্রধান ফটক, রান্নাঘর, মোটর গ্যারেজ, ড্রাইভার কোয়ার্টার, স্টাফ কোয়ার্টার, কোষাগার ভবন ও সেন্ট্রি বক্স মোট ১২টি ভবন রয়েছে। মূল ভবনসহ অন্য ভবনের দরজা-জানালা সব মূল্যবান কাঠ দ্বারা নির্মিত। রাজবাড়ি এলাকাটি একটি পরিখা ও উঁচু প্রাচীর দ্বারাবেষ্টিত। এর পূর্ব পাশে একটি চারতলাবিশিষ্ট পিরামিডাকৃতির প্রবেশদ্বার আছে। এটি ওপরের দিকে ক্রমশ সরু হয়ে একটি ঘড়িবিশিষ্ট টাওয়ারে শেষ হয়েছে। এটি তিন তলার সারিবদ্ধ খিলানপথ ও সর্বোচ্চ তলার ঘড়ির পাশে দু'টি বৃত্তাকার চক্রের উপস্থিতি দ্বারা আরও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়েছে। প্রধান প্রাসাদ বস্নকটির নিকটেই দক্ষিণে 'কুমার প্যালেস' নামে একটি সুন্দর দ্বিতলভবন অবস্থিত। এর ওপরের তলায় চারটি শয়নকক্ষ ও একটি ড্রেসিং রুম আছে আর নিচে রয়েছে সারি সারি কক্ষ। খাজাঞ্চিখানার ছোট ভবনটি কুমার প্যালেসের পেছনে অবস্থিত। একতলার ম্যানেজার অফিসটি উত্তরদিকের প্রবেশপথের নিকটে অবস্থিত। প্রধান বস্নকের দক্ষিণে একতলা রানীমহল এবং আরও কিছু ভবন অবস্থিত। অতিথি ভবন, আস্তাবল, কর্মচারিদের কোয়ার্টার ইত্যাদি সবকিছুই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালের পর অবশ্য এ ভবনে আর কেউ বসবাস করেনি। বর্তমানে এটি দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় নাটোরের জেলা প্রশাসকের অনুমতিসাপেক্ষে উন্মুক্ত রয়েছে। নাটোর জেলা শহর থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত উত্তরা গণভবনটি বর্তমানে উত্তরবঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর স্থানীয় কার্যালয় এবং বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই উত্তরা গণভবন পরিদর্শন করতে জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়।