পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার (চধযধৎঢ়ঁৎ ইঁফফযরংঃ ইরযধৎ) বা সোমপুর মহাবিহার (ঝড়সধঢ়ঁৎধ গধযধারযধৎধ) নামে পরিচিত বৌদ্ধ বিহারটি বর্তমানে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন স্থাপনা। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারটি নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলা থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপাল দেব (৭৮১-৮২১) অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই বিশাল স্থাপনা আবিষ্কার করেন।
ইউনেস্কোর মতে, পাহাড়পুর বিহার বা সোমপুর বৌদ্ধ বিহার দক্ষিণ হিমালয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহার। আয়তনের সঙ্গে ভারতের নালন্দা মহাবিহারের তুলনা হতে পারে। এটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্ম শিক্ষাদান কেন্দ্র ছিল। তৎকালীন সময় তিব্বত, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং মিয়ানমার প্রভৃতি দেশ থেকেও বৌদ্ধরা পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে ধর্মচর্চা ও জ্ঞান অর্জন করতে ছুটে আসতেন। খ্রিষ্টীয় দশম শতকে বিহারের আচার্য ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
পুন্ড্রবর্ধনের রাজধানী পুন্ড্রনগর (বর্তমান মহাস্থান) এবং অপর শহর কোটিবর্ষের (বর্তমান বানগড়) মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত ছিল সোমপুর মহাবিহার। এর ধ্বংসাবশেষটি বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহীর অন্তর্গত নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত। অপরদিকে জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে এর দূরত্ব পশ্চিম দিকে মাত্র ৫ কিলোমিটার। এর ভৌগোলিক অবস্থান ২৫ক্ক০ক্ম উত্তর থেকে ২৫ক্ক১৫ক্ম উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮ক্ক৫০ক্ম পূর্ব থেকে ৮৯ক্ক১০ক্ম পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত। গ্রামের মধ্যে প্রায় ০.১০ বর্গ কিলোমিটার (১০ হেক্টর) অঞ্চলজুড়ে এই পুরাকীর্তিটি অবস্থিত। প্রত্নতাত্ত্বিক এই নিদর্শনটির ভূমি পরিকল্পনা চতুর্ভূজ আকৃতির। এটি বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের পস্নাবন সমভূমিতে অবস্থিত, পস্নাইস্টোসীন যুগের বরেন্দ্র নামক অনুচ্চ এলাকার অন্তর্ভুক্ত। মাটিতে লৌহজাত পদার্থের উপস্থিতির কারণে মাটি লালচে। অবশ্য, বর্তমানে এই মাটি অধিকাংশ স্থানে পললের নিচে ঢাকা পড়েছে। পার্শ্ববর্তী সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০.৩০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত পাহাড়সদৃশ স্থাপনা হিসেবে এটি টিকে রয়েছে। স্থানীয় লোকজন একে গোপাল চিতার পাহাড় আখ্যায়িত করত; সেই থেকেই এর নাম হয়েছে পাহাড়পুর, যদিও এর প্রকৃত নাম সোমপুর বিহার।
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ৯২২ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৯১৯ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত। বিহারটিতে সর্বমোট ১৭৭ টি ঘরে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস করতেন। বিহারের ঠিক মধ্যখানে শোভা বাড়িয়েছে একটি মন্দির, যার দৈর্ঘ্য ৪০০ ফুট ও প্রস্থ ৩৫০ ফুট এবং মন্দিরটি প্রায় ৭০ ফুট উঁচু। মন্দিরের বাইরের দেয়ালে বুদ্ধ ও হিন্দুদের দেবী মূর্তি এবং পোড়া মাটির বেশকিছু ফলক স্থান পেয়েছে। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের মূল বেষ্টনী প্রায় ২০ ফুট চওড়া। বেষ্টনীর ভেতরে আরেকটি বৌদ্ধ মন্দির দেখতে পাওয়া যায়।
চতুষ্কোনাকার পাহাড়পুর বিহারের চারদিক চওড়া সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। সীমানা প্রাচীরের অভ্যন্তরে সারিবদ্ধ ৯২টি ছোট ছোট কক্ষ ছিল। অনুমান করা হয় সবগুলো কক্ষে ভিক্ষুরা বসবাস করতেন এবং পরে কিছু কক্ষকে প্রার্থনা কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিহারের উত্তর দিকের মধ্যে প্রধান প্রবেশ পথ রয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমনের পর তারা সব স্থানে জরিপ কাজ চালানো শুরু করেন। পূর্ব ভারতে জরিপ কাজ পরিচালনা করেন বুকানন হ্যামিল্টন; যিনি ১৮০৭-১৮১২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময় পাহাড়পুর পরিদর্শন করেন। এটিই ছিল পাহাড়পুরে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক পরিদর্শন। এরপর এই প্রত্নস্থল পরিদর্শনে আসেন ওয়েস্টম্যাকট। তারা দেশে ফিরে তাদের অভিজ্ঞতা সংবলিত বিবরণ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এরই সূত্র ধরে ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে আলেকজান্ডার কানিংহাম এই ঐতিহাসিক স্থানটি পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনের পর এই জমিটি ব্যাপক হারে খনন করার প্রতি তিনি আগ্রহ দেখান। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের প্রত্নতাত্ত্বিক আইনের আওতায় এই স্থান ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষিত হয়।
পাহাড়পুরের প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্বকালীন সময় মূলত ব্রিটিশ যুগে এবং দ্বিতীয়ত স্বাধীনতা-উত্তরকালে আশির দশকে। ১৮৭৯ সালে কানিংহাম প্রথম উদ্যোগটি নেন। কিন্তু বলিহারের জমিদারের বিরোধিতায় কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় ঢিবির শীর্ষভাগ খনন করে তাকে থেমে যেতে হয়। এই খননে চারপাশে উদ্গত অংশযুক্ত প্রায় ৭মি উঁচু একটি কক্ষ আবিষ্কৃত হয়। এর দীর্ঘদিন পর ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বরেন্দ্র গবেষণা পরিষদ ও ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের যৌথ প্রচেষ্টায় এবং দিঘাপতিয়ার জমিদার পরিবারের সদস্য শরৎ কুমার রায়ের অর্থানুকূল্যে পুনরায় খননকাজ শুরু হয়। এ বছর ঐতিহাসিক ডি. আর. ভান্ডারকরের নেতৃত্বে প্রত্নস্থলটির দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে খনন পরিচালিত হলে উত্তর-দক্ষিণে বিন্যস্ত একসারি কক্ষ এবং চত্বরের অংশবিশেষ পাওয়া যায়। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯২৫-২৬ সালে খনন করে কেন্দ্রীয় ঢিবির উত্তরে প্রধান সিঁড়ি, পোড়ামাটির ফলকচিত্র শোভিত দেয়াল ও প্রদক্ষিণ পথসহ উত্তর দিকের মন্ডপ বা হলঘর আবিষ্কার করেন। ফলে প্রথমবারের মতো এই বিহারের ভূমি পরিকল্পনা ও দেয়ালচিত্রণ সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। ১৯৩০-৩১ এবং ১৯৩১-৩২ সালে জি.সি.চন্দ্র বিহারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ ও সংলগ্ন চত্বর খনন করেন। ১৯৩৩-৩৪ সালে কাশিনাথ দীক্ষিতের তত্ত্বাবধানে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ পুনরায় খনন করে। এতে বিহার ও মন্দিরের অবশিষ্ট অংশ এবং সত্যপীরের ভিটায় একগুচ্ছ স্তূপসহ একটি তারা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়।