বাংলাদেশের এক গৌরবময় জনপদ সোনারগাঁও। শিল্পকলা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যে সোনারগাঁও ছিল উলেস্নখযোগ্য। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবেষ্টিত, নৈসর্গিক পরিবেশের প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁও। এই নামটির উদ্ভব হয়েছে সুবর্ণগ্রাম থেকে। আবার অনেকের মতে বারো ভুঁইয়ার প্রধান ঈশা খাঁর স্ত্রী সোনাবিবির নামে সোনারগাঁওর নামকরণ করা হয়েছে। আনুমানিক ১২৮১ খ্রিষ্টাব্দে এই অঞ্চলে মুসলিম আধিপত্যের সূচনার পর আওরঙ্গজেবের আমলে বাংলার রাজধানী ঢাকা ঘোষণা হওয়ার আগপর্যন্ত মুসলিম সুলতানদের রাজধানী ছিল সোনারগাঁও। যদিও তখন প্রাচীন এই রাজধানী পানাম নামেই পরিচিত ছিল। ঈশা খাঁ ও তার বংশধরদের শাসনামলে সোনারগাঁও ছিল পূর্ববঙ্গের রাজধানী।
সোনারগাঁও ছিল বাংলার মুসলিম শাসকদের অধীন পূর্ববঙ্গের একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা। এর অবস্থান ঢাকা থেকে ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে। মধ্যযুগীয় নগরটির যথার্থ অবস্থান নির্দেশ করা কঠিন। বিক্ষিপ্ত নিদর্শনাদি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এটি পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী ও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বেষ্টিত একটি বিস্তৃত জনপদ ছিল।
সোনারগাঁও বাংলার ঐতিহাসিক অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন রাজধানী এবং পূর্ববাংলার একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। এটি একটি নদী বন্দরও ছিল। তাঁতি ও কারিগরদের বিশাল জনসংখ্যার সঙ্গে বাংলার মসলিন বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সোনারগাঁও। প্রাচীন গ্রিক ও রোমান বিবরণ অনুসারে এই পশ্চাদভূমিতে অ্যাম্পোরিয়াম বা বাণিজ্যিক কেন্দ্র অবস্থিত ছিল, যা প্রত্নতাত্ত্বিকরা ওয়ারী-বটেশ্বর ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে শনাক্ত করেছেন। অঞ্চলটি বঙ্গ, সমতট, সেন এবং দেব রাজবংশের একটি ঘাঁটি ছিল।
দিলিস্ন সালতানাতের সময় সোনারগাঁও গুরুত্ব লাভ করে। এটি ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ এবং তার পুত্র ইখতিয়ারউদ্দিন গাজী শাহ দ্বারা শাসিত সালতানাতের রাজধানী ছিল। এখানে রাজদরবার এবং বাংলা সালতানাতের টাঁকশাল এবং গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে বঙ্গীয় সালতানাতের রাজধানীও ছিল। এ সময় সোনারগাঁও বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জনপদে পরিণত হয়। অনেক অভিবাসী ওই এলাকায় বসতি স্থাপন করে। সুলতানরা মসজিদ ও সমাধি নির্মাণ করেন। পরে এটি বারো-ভূঁইয়ার ঈসা খাঁন এবং তার ছেলে মুসা খানের নেতৃত্বে মুঘল সম্প্রসারণকে প্রতিহত করেছিল। বারো ভূঁইয়াদের পরাজয়ের পর সোনারগাঁও মুঘল সুবাহ বাংলার একটি জেলায় পরিণত হয়।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে, বণিকরা পানাম পাড়ায় অনেকগুলো ইন্দো-সারাসেনিক টাউনহাউস তৈরি করেছিল। ১৮৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত নিকটবর্তী নারায়ণগঞ্জ বন্দরের মাধ্যমে এর গুরুত্ব শেষ হয়ে যায়।
সোনারগাঁও বেশকিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর, জয়নুল আবেদিন স্মৃতি জাদুঘর, পানাম সিটি ও বাংলার তাজমহল।
প্রাচীন লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর
আবহমান গ্রামবাংলার সংস্কৃতি ও লোকশিল্পকে ধরে রাখা ও সর্বজন স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্দেশ্য ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁওয়ের পানাম নগরীর একটি পুরনো বাড়িতে এই ফাউন্ডেশনটি প্রতিষ্ঠা করেন। পানাম নগরীর ঠাকুরবাড়ী ভবন ও ঈশা খাঁর তোরণ এই দুটিকে একত্রে নিয়ে প্রায় ১৬ হেক্টর জায়গাজুড়ে কারু ও লোকশিল্প ফাউন্ডেশনের অবস্থান। এই ফাউন্ডেশনে ১টি জাদুঘর, ১টি লোকজ মঞ্চ, সেমিনার রুম ও কারুশিল্প গ্রাম রয়েছে। প্রায় সাড়ে চার হাজার প্রাচীন নির্দশন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যথাযথভাবে সংরক্ষিত রয়েছে এই জাদুঘরে। জাদুঘরটিতে আছে বাংলাদেশের গ্রামবাংলার প্রাচীন শিল্পীদের সুনিপুণ হাতের তৈরি বিভিন্ন শৈল্পিক ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য নানা পণ্যসামগ্রী। এই প্রতিটি হস্তশিল্পতে দক্ষ শিল্পীরা ফুটিয়ে তুলেছে প্রাচীন বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্য। এ ছাড়া গ্যালারিগুলোতে দেখা মিলবে কাঠে খোদাই করা শিল্প, কারুশিল্প, পটচিত্র ও মুখোশ, আদিম জীবনভিত্তিক নিদর্শন, লোকজ বাদ্যযন্ত্র, পোড়ামাটির ফলক, লোহা তামা কাসা ও পিতলের তৈজসপত্র, লোকজ অলংকারসহ প্রাচীন অনেক নিদর্শন।
জয়নুল আবেদিন স্মৃতি জাদুঘর
লোকশিল্প জাদুঘরের পূর্বে রয়েছে জয়নুল আবেদিন স্মৃতি জাদুঘর। এই পুরো ভবনে রয়েছে মাত্র দুটি গ্যালারি। এর মধ্যে একটি গ্যালারি কাঠের তৈরি যা প্রাচীন ও আধুনিক কালের নিদর্শন সমৃদ্ধ। এ ছাড়া কাঠ বিভিন্ন কারুপণ্য তৈরি করে বিক্রি করার সামগ্রিক প্রক্রিয়া সুন্দর মডেলের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।
লোকশিল্প মেলা
সাধারণত প্রত্যেক বছর শীতকালে মাসব্যাপী লোকশিল্প মেলা হয়ে থাকে। তবে পহেলা বৈশাখ এর আগে এই মেলা হয় অনেক সময়। মূলত গ্রামীণ আবহে এই মেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলায় বসে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক জামদানির হাট। এ ছাড়া গ্রামীণ নানা আনুষঙ্গিক সব ধরনের জিনিসপত্রসহ গজা, মুড়ি মুড়কির খুচরা দোকানেরও সন্ধান মেলে এই মেলায়। বাচ্চাদের জন্য নাগরদোলা সহ আরও কিছু বিনোদনেরও ব্যবস্থা থাকে এই মেলায়।