ইতিহাস ও ঐতিহ্য
আর্মেনীয় গির্জা
প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
আর্মেনীয় গির্জা পুরান ঢাকার একটি প্রাচীন খ্রিস্টধর্মীয় উপাসনালয়। এটি ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় অবস্থিত। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে ঢাকায় অনেক আর্মেনীয় ব্যক্তির আগমন ঘটে। গির্জা নির্মাণের পূর্বে ওই স্থানে ছিল আর্মেনীয়দের একটি কবরস্থান।
ঢাকায় বসবাসরত আর্মেনীয়দের মৃত্য হলে এখানে কবর দেওয়া হতো। অন্য সব গির্জা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এই আর্মেনীয় গির্জা। এই গির্জার আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য সমাধিসৌধ। ১৭৮১ সালে নির্মিত চার্চটি ঢাকায় আর্মেনীয় সম্প্রদায়ের স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। অন্য সব ক্যাথলিক/ব্যাপ্টিস্ট চার্চ থেকে এই চার্চটি সম্পূর্ণ আলাদা। এখনো আর্মেনীয়দের অবশিষ্ট বংশধর এই চার্চের রক্ষণাবেক্ষণ করছে।
ঐতিহ্যবাহী এই চার্চের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঢাকায় আর্মেনীয়দের ইতিহাস। আনুমানিক সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে দুই-একজন করে আর্মেনীয় বনিক ঢাকায় আশা শুরু করে। ধারণা করা হয় তাদের নাম অনুসারে পুরান ঢাকার আরমানিটোলার নামকরণ করা হয়। ৭০০ ফুট লম্বা গির্জাটির রয়েছে ৪টি দরজা আর ২৭টি জানালা। ভেতরে সারি সারি চেয়ার সাজানো রয়েছে আর রয়েছে পাদ্রি বসার জন্য একটি বেদি।
আর্মানিটোলায় বসবাস শুরু করার পর আর্মেনীরা এখানে তাদের এই গির্জা নির্মাণ করেন। মৃতু্যর পর ঢাকার আর্মেনীদের কবর দেওয়া হয় এখানে। আর্মেনী গির্জার চতুর্দিকের প্রাঙ্গণের পরিসর ছোট হওয়ার কারণেই হয়তো গির্জাটির গোটা প্রাঙ্গণ এমনকি বারান্দার মেঝেতেও প্রচুর সমাধিফলক চোখে পড়ে। অধিকাংশ এপিটাফ বা স্মৃতিফলকে উদ্ধৃত রয়েছে ধর্মগ্রন্থের বাণী। এছাড়া জনৈক ক্যাটচিক আভেটিক থমাসের সমাধির ওপর তার স্ত্রী কলকাতা থেকে কিনে এনে বসিয়েছিলেন সুন্দর এক মূর্তি, যা এখনো টিকে আছে। এপিটাফে তিনি তার স্বামীকে উলেস্নখ করেছিলেন 'বেস্ট অব হাজব্যান্ডস' বলে।
গির্জার আশপাশে রয়েছে প্রায় শ'খানেক আর্মেনীয়দের কবর। গির্জাটি ব্যক্তি মালিকানাধীন। সারা বছরই তালা মারা থাকে। অনুমতি সাপেক্ষে ভিতরে প্রবেশ করা যায়।
উলেস্নখ্য যে, আর্মেনীয়রা ব্যবসার উদ্দেশে আঠারো শতকের দিকে ঢাকায় আসতে শুরু করে। লবণ-চামড়া-কাপড় আর পাটের ব্যবসা করে আর জমিদারি কিনে অল্প সময়েই তারা ঢাকার একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী হয়ে ওঠে। যে অঞ্চলে আর্মেনীয়রা বসবাস করতে শুরু করে তার নাম হয়ে যায় আর্মানিটোলা। তারপর কোম্পানি আমলের শেষ দিকে এসে ব্যবসা করতে শুরু করে। আর পাকিস্তান আমলে ঢাকায় আর্মেনীয়দের বাস প্রায় উঠে যায়। ১৯৯১ সালে নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা নেফিয়েট স্টেফানের মৃতু্যর মধ্য দিয়ে ঢাকার সঙ্গে আর্মেনীয়দের সম্পর্কের শেষ সূত্রটিও হারিয়ে যায়।
এই গির্জার জন্য জমি দান করেন আগা মিনাস ক্যাটচিক। ১৮৮০ সালে আর্থিক অনটনে পড়ে গির্জার ঘণ্টাটি বাজানো বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে গির্জার ঘড়িঘর বিধ্বস্ত হয়। গির্জার অঙ্গনে আর্মেনীয়দের কবরস্থান অবস্থিত।
আর্মেনীয় গির্জাটি আরমানিটোলা ও স্যার সলিমুলস্নাহ মেডিকেল কলেজের মধ্যে চার্চ রোডে অবস্থিত। অষ্টাদশ শতকে পুরান ঢাকার আর্মেনীয় বসতি থেকেই গির্জাটি আর্মেনীয় গির্জা নামে পরিচিত হয়। একটি প্রাচীন প্রতিষ্ঠাফলক থেকে জানা যায় গির্জাটি ১৭৮১ সালে নির্মিত হয়েছিল। গির্জার ঘণ্টাঘরের পাশে ক্লক টাওয়ার হিসেবে একটি সুদৃশ্য গির্জাচূড়া ১৮৩৭ সালে নির্মাণ করা হয় যা ১৮৯৭ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ে।
১৭৮১ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে গির্জার স্থানটিতে একটি কবরস্থান ছিল। আগা ক্যাটচিক মিনাস (অমধ ঈধঃপযরপশ গরহধং) গির্জার জন্য এই জমিটি দান করেন। তার স্ত্রী সোফি ১৭৬৪ সালে মৃতু্যবরণ করেন এবং তাকে গির্জায় সমাধিস্থ করা হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডেভিডসন ১৮৪০ সালে গির্জাটি পরিদর্শন করেন এবং সেখানে বড়দিন উদযাপন প্রত্যক্ষ করেন।
গির্জার মূল ভবনটিতে ১৪ ফুট প্রশস্ত আঙিনা রয়েছে। আয়তাকার ভবনটি তিনটি অংশে বিভক্ত- একপাশে রেলিংবেষ্টিত উচ্চ বেদি, একটি কেন্দ্রীয় প্রার্থনাগৃহ এবং নারী ও শিশুদের জন্য সংরক্ষিত গ্যালারিযুক্ত একটি অংশ। ১০ ফুট উঁচু বেদিটি সম্ভবত কাঠের তৈরি। বেদিটি দেয়াল থেকে ৪ ফুট দূরবর্তী অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজবিশিষ্ট ছাদের নিচে স্থাপিত।
ঊনিশ শতকের ঢাকায় পরিচিত ও প্রভাবশালী পরিবার হিসেবে যে কয়েকটি আর্মেনীয় পরিবারের নাম পাওয়া যায় সেগুলো হলো- পোগস, আরাতুন, পানিয়াটি, স্টিফান, লুকাস, কোজা মাইকেল, মানুক, হার্নি, সিরকোর এবং সার্কিস। এদের বিত্তের ভিত্তি ছিল জমিদারি ও ব্যবসা। বিদেশি হয়েও জমিদারি কেনার কারণ হতে পারে- আভিজাত্য অর্জন এবং সমাজের শীর্ষে থাকা। এসব ধনী আর্মেনীয়রা ঢাকায় নিজেদের থাকার জন্য তৈরি করেছিলেন প্রাসাদতুল্য সব বাড়ি।