ইতিহাস ও ঐতিহ্য
প্রকাশ | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
লালবাগ কেলস্না
বাংলাদেশে চারশ' বছরের ইতিহাসের সাক্ষী মুঘল আমলের একমাত্র ঐতিহাসিক নিদর্শন আওরঙ্গবাদ বা লালবাগ কেলস্না। পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকার বুড়িগঙ্গা নদীর কূলঘেঁষে এর অবস্থান। প্রতিদিন দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে প্রাচীন ইতিহাস ও সভ্যতার এই নিদর্শনটি। এ নিদর্শনে ব্যবহার করা হয়েছে কষ্টি পাথর, মার্বেল পাথর এবং বাহারি রঙের টালির মিশ্রণ।
লালবাগ কেলস্নায় প্রবেশের মুখেই রয়েছে সুন্দর ফুলের বাগান। শত্রম্নদের প্রতিহত করার জন্য দুর্গের ভেতর মুঘল আমলে একটি সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে এই সুড়ঙ্গ পথে জনসাধারণের প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অনেকের মতে, একসময় এই সুড়ঙ্গ পথে দর্শনার্থীরা প্রবেশ করতে পারত।
লালবাগের কেলস্না (আওরঙ্গবাদ কেলস্না) ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত একটি অসমাপ্ত মুঘল দুর্গ। এটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৬৭৮ সালে। মুঘল সুবেদার মুহাম্মদ আজম শাহ কর্তৃক, যিনি ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র এবং পরবর্তীতে নিজেও সম্রাট হয়েছিলেন। কিন্তু পরে তিনি দিলিস্নতে চলে যান এতে কাজ থেমে যায়। তার উত্তরসূরি, মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালে নির্মাণকাজ পুনরায় শুরু করেন। কিন্তু শেষ করতে পারেননি। কারণ মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁর কন্যা পরী বিবি মারা যান। এ কারণে তিনি নির্মাণকাজ থামিয়ে দেন।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের ৩য় পুত্র, মুঘল রাজপুত্র আজম শাহ বাংলার সুবেদার থাকাকালীন ১৬৭৮ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু করেন। তিনি বাংলায় ১৫ মাস ছিলেন। দুর্গের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই মারাঠা বিদ্রোহ দমনের জন্য পিতা সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দিলিস্ন ডেকে পাঠান। এ সময় একটি মসজিদ ও দরবার হল নির্মাণের পর দুর্গ নির্মাণের কাজ থেমে যায়। সুবেদার শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালে পুনরায় বাংলার সুবেদার হিসেবে ঢাকায় এসে দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু করেন। ১৬৮৪ সালে এখানে শায়েস্তা খাঁর কন্যা ইরান দুখত রাহমাত বানুর (পরী বিবি) মৃতু্য ঘটে। শায়েস্তা খাঁ কন্যার মৃতু্যর পর দুর্গটির কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় রেখে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন।
শায়েস্তা খাঁ ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তর করেন। মুঘল আমল সমাপ্ত হওয়ার পর দুর্গটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়ে যায়। ১৮৪৪ সালে এলাকাটি 'আওরঙ্গবাদ' নাম বদলে 'লালবাগ' নাম পায় এবং দুর্গটি পরিণত হয় লালবাগ দুর্গে।
দীর্ঘ সময় যাবত এটি ধারণা করা হতো যে, দুর্গটি হচ্ছে তিনটি ভবন স্থাপনার সমন্বয়ে- মসজিদ, পরী বিবির সমাধি ও দেওয়ান-ই-আম। এছাড়া দুটি বিশাল তোরণ ও আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত মজবুত দুর্গ প্রাচীর রয়েছে। লালবাগের কেলস্নার তিনটি প্রধান স্থাপনার একটি হলো পরী বিবির সমাধি।
দক্ষিণস্থ দুর্গ প্রাচীরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি বিরাট বুরুজ ছিল। দক্ষিণস্থ দুর্গ প্রাচীরের উত্তরে ছিল কয়েকটি ভবন, আস্তাবল, প্রশাসনিক ভবন এবং পশ্চিম অংশে জলাধার ও ফোয়ারাসহ একটি সুন্দর ছাদ-বাগান।
আবাসিক অংশটি ছিল দুর্গ প্রাচীরের পশ্চিম-পূর্বে, প্রধানত মসজিদটির দক্ষিণ-পশ্চিমে।
দক্ষিণের দুর্গ প্রাচীরে নির্দিষ্ট ব্যবধানে ৫টি বুরুজ ছিল উচ্চতায় দুই তালার সমান এবং পশ্চিমের দুর্গ প্রাচীরে ছিল ২টি বুরুজ যার সবচেয়ে বড়টি ছিল দক্ষিণস্থ প্রধান প্রবেশদ্বারে।
বুরুজগুলোর ছিল একটি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ। কেলস্নাটির কেন্দ্রীয় এলাকা দখল করে ছিল তিনটি প্রধান ভবন। পূর্বে দেওয়ান-ই-আম ও হাম্মাম খানা, পশ্চিমে মসজিদটি এবং পরী বিবির সমাধি দুটোর মাঝখানে এক লাইনে কিন্তু সমান দূরত্বে নয়। নির্দিষ্ট ব্যবধানে কয়েকটি ফোয়ারাসহ একটি পানির নালা তিনটি ভবনকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ও উত্তর থেকে দক্ষিণে সংযুক্ত করেছে।
দেওয়ান-ই-আম
হাম্মাম খানা মূলত সুবেদারদের বাস ভবন হিসেবে ব্যবহার হতো। লালবাগ কেলস্নার এই দালানকে দুটি কাজে ব্যবহার করা হতো। হাম্মাম খানা (বাস ভবন হিসেবে), দেওয়ানে আম (বিচারালয় হিসেবে)। এই দালানের নিচতলা ছিল বাস ভবন তথা হাম্মাম খানা আর উপরের তলা ছিল আদালত বা দেওয়ানে আম। শায়েস্তা খাঁ এই ভবনে বাস করতেন এবং এটাই ছিল তার আদালত। এখান থেকে তিনি সমস্ত বিচারকার্য পরিচালনা করতেন।
পরী বিবির সমাধি
লালবাগ কেলস্নার তিনটি স্থাপনার মধ্যে অন্যতম এটি। এখানে পরী বিবি সমাহিত আছেন। শায়েস্তা খাঁ তার কন্যার স্মরণে এই মনমুগ্ধকর মাজারটি নির্মাণ করেন। লালবাগ কেলস্নার তিনটি বিশাল দরজার মধ্যে বর্তমানে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। এই দরজা দিয়ে ঢুকলে বরাবর সোজা চোখে পড়ে পরী বিবির সমাধি। আসলে 'লালবাগ কেলস্না' বলতে যেই ছবিটি বেশি পরিচিত সেটি মূলত পরী বিবির সমাধির ছবি। পরী বিবি যার অন্য নাম ইরান দুখত রহমত বানু ছিলেন সুবাহ বাংলার মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খানের কন্যা। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা মুহাম্মদ আজমের সঙ্গে ১৬৬৮ সালের ৩ মে পরী বিবির বিয়ে হয়। ১৬৮৪ সালে পরী বিবির অকালমৃতু্যর পর তাকে নির্মাণাধীন লালবাগ কেলস্নার অভ্যন্তরে সমাহিত করা হয়। তার সমাধীস্থলকে চিহ্নিত করে পরী বিবির মাজার নির্মিত হয়। পরী বিবির মাজারের স্থাপনাটি চতুষ্কোণ। মার্বেল পাথর, কষ্টি পাথর ও বিভিন্ন রঙের ফুল-পাতা সুশোভিত চাকচিক্যময় টালির সাহায্যে অভ্যন্তরীণ নয়টি কক্ষ অলংকৃত করা হয়েছিল। মাঝের একটি ঘরে পরী বিবির সমাধিস্থল এবং এই ঘরটি ঘিরে আটটি ঘর আছে। স্থাপনাটির ছাদে করবেল পদ্ধতিতে কষ্টি পাথরে তৈরি এবং চারকোণে চারটি অষ্টকোণ মিনার ও মাঝে একটি অষ্টকোণ গম্বুজ আছে। মূল সমাধিসৌধের কেন্দ্রীয় কক্ষের উপরের এই গম্বুজটি একসময়ে স্বর্ণখচিত ছিল, পরবর্তীতে পিতলের/তামার পাত দিয়ে পুরো গম্বুজটিকে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্থাপনাটির অভ্যন্তর ভাগ সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে আচ্ছাদিত ছিল। ২০.২ মিটার বর্গাকৃতির এই সমাধিটি ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে নির্মিত। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত বর্তমানে এখানে পরি বিবির মরদেহ নেই।
শাহী মসজিদ
সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র শাহজাদা আজম বাংলার সুবেদার থাকাকালীন তিন গম্বুজওয়ালা দুর্গ মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন ১৬৭৮-৭৯ খ্রিষ্টাব্দে। আয়তাকারে (১৯.১৯ মি. ী ৯.৮৪ মি) নির্মিত তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি এদেশের প্রচলিত মুঘল মসজিদের একটি আদর্শ উদাহরণ। বর্তমানেও মসজিদটি মুসলিস্নদের নামাজের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে।