ইতিহাস ও ঐতিহ্য
প্রকাশ | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
আহসান মঞ্জিল
আহসান মঞ্জিল পুরান ঢাকার ইসলামপুরের কুমারটুলী এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত, যা পিঙ্ক প্যালেস নামেও পরিচিত। এটি পুরান ঢাকায় অবস্থিত একটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক নিদর্শন। আহসান মঞ্জিল ১৯ শতকের শেষের দিকে নির্মিত হয়েছিল। এটি ঢাকার নবাবদের সরকারি বাসভবন। আবাসিক প্রাসাদ ও জমিদারির সদর কাচারি হিসেবেও পরিচিত হয়েছিল।
বর্তমানে এটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব আবদুল গনি। তিনি তার পুত্র খাজা আহসানুলস্নাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে আহসান মঞ্জিলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে সমাপ্ত হয়। প্রাসাদটি ব্রিটিশ স্থপতি রবার্ট চিশলম দ্বারা ডিজাইন করা হয়েছিল। যিনি ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলী দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। ঢাকার নবাবরা ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্তির আগ পর্যন্ত আহসান মঞ্জিলকে তাদের সরকারি বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করতেন।
১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে এখানে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর আহসান মঞ্জিল পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৫০ এর দশকে প্রাসাদটিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার জাতীয় ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরবর্তীতে ১৯৮০ এর দশকে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আহসান মঞ্জিল সংস্কার ও পূর্বের গৌরব পুনরুদ্ধার করা হয়।
এখন এটি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কর্তৃক পরিচালিত একটি জাদুঘর।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জামালপুর পরগনার জমিদার শেখ ইনায়েতউলস্নাহ আহসান মঞ্জিলের বর্তমান স্থানে রংমহল নামে একটি প্রমোদভবন তৈরি করেন। পরবর্তীতে তার পুত্র শেখ মতিউলস্নাহ রংমহলটি ফরাসি বণিকদের কাছে বিক্রি করে দেন। বাণিজ্য কুঠি হিসেবে এটি দীর্ঘদিন পরিচিত ছিল। এরপরে ১৮৩০-এ বেগমবাজারে বসবাসকারী নওয়াব আবদুল গনির পিতা খাজা আলীমুলস্নাহ এটি ক্রয় করে বসবাস শুরু করেন। এই বাসভবনকে কেন্দ্র করে খাজা আবদুল গনি মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি নামক একটি ইউরোপীয় নির্মাণ ও প্রকৌশল-প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে একটি মাস্টারপস্ন্যান তৈরি করান, যার প্রধান ইমারত ছিল আহসান মঞ্জিল। ১৮৫৯ সালে নওয়াব আবদুল গনি প্রাসাদটি নির্মাণ শুরু করেন, যা ১৮৭২ সালে সমাপ্ত হয়। তিনি তার প্রিয় পুত্র খাজা আহসানুলস্নাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন 'আহসান মঞ্জিল'। ওই যুগে নবনির্মিত প্রাসাদ ভবনটি রংমহল ও পুরাতন ভবনটি অন্দরমহল নামে পরিচিত ছিল।
১৮৮৮ সালের ৭ এপ্রিল প্রবল ভূমিকম্পে পুরো আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত আহসান মঞ্জিল পুনর্র্নির্মাণের সময় বর্তমান উঁচু গম্বুজটি সংযোজন করা হয়। পুনর্র্নির্মাণ ও মেরামতের জন্য রাণীগঞ্জ থেকে উন্নতমানের ইট আনা হয়। মেরামতকর্ম পরিচালনা করেন প্রকৌশলী গোবিন্দ চন্দ্র রায়। সে আমলে ঢাকা শহরে আহসান মঞ্জিলের মতো এত জাঁকালো ভবন আর ছিল না। এর প্রাসাদোপরি গম্বুজটি শহরের অন্যতম উঁচু চূড়া হওয়ায় তা বহু দূর থেকেও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করত।
১৮৯৭ সালে ১২ই জুন ঢাকায় ভূমিকম্প আঘাত হানলে আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। আহসান মঞ্জিলের দক্ষিণের বারান্দাসহ ইসলামপুর রোড সংলগ্ন নহবতখানাটি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। পরবর্তীকালে নবাব আহসানুলস্নাহ তা পুনর্নির্মাণ করেন। ১৯৫২ সালে জমিদারী উচ্ছেদ আইনের আওতায় ঢাকা নওয়াব এস্টেট সরকার অধিগ্রহণ করে। কিন্তু নওয়াবদের আবাসিক ভবন আহসান মঞ্জিল এবং বাগানবাড়িসমূহ অধিগ্রহণের বাইরে থাকে। এই প্রাসাদের ছাদের ওপর সুন্দর একটি গম্বুজ আছে। এক সময় এই গম্বুজের চূড়াটি ছিল ঢাকা শহরের সর্বোচ্চ। মূল ভবনের বাইরে ত্রি-তোরণবিশিষ্ট প্রবেশদ্বারও দেখতে সুন্দর। একইভাবে ওপরে ওঠার সিঁড়িগুলোও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে দু'টি মনোরম তোরণ আছে যা সবচেয়ে সুন্দর। ১ মিটার উঁচু বেদির ওপর স্থাপিত দ্বিতল প্রাসাদ ভবনটির পরিমাপ ১২৫ দশমিক ৪ মিটার এবং ২৮ দশমিক ৭৫ মিটার। নিচতলায় মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত উচ্চতা ৫ মিটার ও দোতলায় ৫ দশমিক ৮ মিটার। প্রাসাদের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একতলার সমান উঁচু করে গাড়ি বারান্দা। দক্ষিণ দিকের গাড়ি বারান্দার ওপর দিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে একটি সুবৃহৎ খোলা সিঁড়ি সম্মুখের বাগান দিয়ে নদীর ধার পর্যন্ত নেমে গেছে। সিঁড়ির সামনে বাগানে একটি ফোয়ারা ছিল, যা বর্তমানে নেই। প্রাসাদের উভয় তলার উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে অর্ধবৃত্তাকার খিলানসহযোগে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দা ও কক্ষগুলোর মেঝে মার্বেল পাথরে শোভিত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অযত্ন ও অপব্যবহারে আহসান মঞ্জিল ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়। তখন ১৯৭৪ সালে ঢাকা নওয়াব পরিবারের উত্তরসূরিরা আহসান মঞ্জিল প্রাসাদ নিলামে বিক্রির পরিকল্পনা করেন। সরকারের ভূমি প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষে নিলাম বিক্রির প্রস্তাবটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে পেশ করা হয়। কিন্তু তিনি আহসান মঞ্জিলের স্থাপত্যসৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৯৭৪ সালের ২রা নভেম্বর এটি নিলামে বিক্রির প্রস্তাব নাকচ করে দেন।
১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস ও স্থাপত্য নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য আহসান মঞ্জিল ভবনটি সংস্কার করে জাদুঘরে রূপান্তর ও প্রাসাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভবনটির পারিপার্শ্বিক এলাকার উন্নয়ন করার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এরপর ১৯৯২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আহসান মঞ্জিল জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ও জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
বর্তমানে আহসান মঞ্জিল ঢাকার একটি জাদুঘর এবং জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। ভ্রমণপ্রিয় দর্শনার্থীরা প্রাসাদের বিভিন্ন কক্ষ ঘুরে দেখতে পারেন এবং ঢাকার নবাবদের ইতিহাস এবং তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারেন। প্রাসাদটিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে মুঘল ও ব্রিটিশ আমলের নিদর্শন ও ধ্বংসাবশেষের একটি বড় সংগ্রহ রয়েছে।