বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১

নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় অষ্টম ও নবম শ্রেণি

ইয়াসিন মাহমুদ আলিফ বি এ, এমএ (ইংরেজি) বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি) আছমত আলী খান ইনস্টিটিউশন, বরিশাল
শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
  ০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় অষ্টম ও নবম শ্রেণি

যুগের সঙ্গে তাল মিলানোর ক্ষেত্রে এক যুগ পর 'জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১' শিক্ষানীতিতে পরিবর্তন আনা হলো। গত বছর ক্লাস সিক্স-সেভেনে চালু হলেও এবার অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চালু হলো নতুন শিক্ষাক্রম। তবে বিগত পাঁচ দশক ধরে চলা শিক্ষানীতির থেকে এবারে শিক্ষানীতি পুরোপুরি ভিন্ন। কারণ আগে ছিল পুরোপুরি পরীক্ষানির্ভর এবং বর্তমান রয়েছে যোগ্যতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন। এর আগে শিক্ষার্থী ক্লাসে না এসেও বছর শেষে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পরবর্তী ক্লাসে প্রমোশন পেত, তবে এখন সেটা অসম্ভব। প্রতিটা শিক্ষার্থীকে বছরে অন্তত ৭০ শতাংশ উপস্থিতি রাখতে হবে। বছর শেষে শুধুমাত্র একটি বা দুটি পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে না বরং বছরের প্রতি শিখন শেষে মূল্যায়ন হবে। আগে শুধুমাত্র তাত্ত্বিক জ্ঞান দিয়েই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যেত তবে এখন শুধু জ্ঞান হলেই চলবে না এর পাশাপাশি ওই তাত্ত্বিক জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগও জানতে হবে। এতে পরিবর্তন হয়েছে ক্লাস নেওয়ার ধরন। আগে শিক্ষকরা শুধুমাত্র একপাক্ষিক লেকচার মেথড ব্যবহার করে ক্লাস নিত তবে এখন ক্লাসে ডেমোক্রেটিক উপায়ে সবার মতামতকে সমান গুরুত্ব দিয়ে এবং শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ক্লাস নিতে হবে। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তবে মুদ্রার শুধু এই পিঠটা দেখলেই চলবে না অপর পিঠটাও দেখতে হবে। নতুন এই শিক্ষা কার্যক্রমে তাত্ত্বিকভাবে অনেক ফলপ্রসু মনে হলেও বাস্তবিক ক্ষেত্রে সারা দেশে এর প্রয়োগ ঘটাতে কিছুটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। কারণ বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশের শহরে শিক্ষার্থীর মান এবং গ্রামের শিক্ষার্থীর মানের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষার জন্য নানারকম উপকরণ প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে শহরের শিক্ষার্থীরা অগ্রাধিকার পেয়ে থাকবে। যার ফলে শহরের শিক্ষার্থীরা যত সহজে অংশগ্রহণ করতে পারবে গ্রামের শিক্ষার্থীরা সেক্ষেত্রে অনেকটা বাধার সম্মুখীন হবে। সেক্ষেত্রে সেখানকার শিক্ষকের মান, শিক্ষার উপকরণ এবং অভিভাবকের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রম বুঝতে হলে প্রথমে অভিভাবককে বিষয়টা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে, অন্যথায় ফলপ্রসু হবে না। ১২৪ পৃষ্ঠার নতুন শিক্ষাক্রমটি নিঃসন্দেহে আমাদের শিক্ষার ইতিহাসে ইতিবাচক পরিবর্তন। এই পরিবর্তন আমাদের নিয়ে যাবে এক নতুন দিগন্তে। শিক্ষার্থীরা হবে যোগ্যতানির্ভর। পড়া শেষে তাদের চাকরির প্রতি মুখিয়ে থাকার প্রয়োজন হবে না। তবে এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে শুধুমাত্র শিক্ষক এবং অভিভাবক না, এ ছাড়াও আমাদের সমাজের মানুষকে সচেতন হতে হবে এবং শিক্ষার্থীকে সাহায্য করতে হবে। তবেই এর যথাযথ উদ্দেশ্য পূরণ হবে এবং শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।

নতুন শিক্ষাক্রম কেন হচ্ছে :নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় বলা হচ্ছে- মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম, সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের আনন্দময় ও উপভোগ্য পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বোঝা ও চাপ কমিয়ে, গভীর শিখনের বিষয়ে গুরুত্বে মুখস্থ-নির্ভরতার পরিবর্তে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শিখনের অগ্রাধিকার প্রদান করা হবে। এছাড়া খেলাধুলা এবং সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বেড়ে শিক্ষার ওপর ভীতি দূর হবে। পাঠ্যপুস্তক হবে আনন্দময় এবং শিখন হবে উৎসাহে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবন শেষে বাস্তবিক শিক্ষা কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে। প্রতিটা শিক্ষার মূলনীতি হচ্ছে সৎ নিষ্ঠাবানে পরিপূর্ণ মূল্যায়নে মানুষ তৈরি করা।

তবে এবারের শিক্ষাক্রমে একজন মানবিক মানুষ তৈরির পাশাপাশি একজন দার্শনিক, ঐতিহাসিক, মনোবিজ্ঞান, সাহিত্যিক, খেলোয়াড়, শিল্পী হিসেবেও গড়ে তোলার পাশাপাশি বাস্তবসম্মতভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির প্রতি অগ্রাধিকারের কথা বলা হচ্ছে।

নতুন শিক্ষাক্রমের ভিত্তি :নতুন শিক্ষাক্রমের মূল ভিত্তি হচ্ছে যোগ্যতা বা পারদর্শিকতা। নতুন শিক্ষাক্রমের যোগ্যতার মূল ভিত্তি হচ্ছে জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে পরিবর্তিত সমাজে অভিযোজন। এসব কিছুর সমন্বয়ে শিক্ষার্থীকে বাস্তবসম্মত শিক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমুন্নত রাখা এই শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্য। এই যোগ্যতাকে সামনে রেখে কিছু নতুন শব্দ আমাদের মধ্যে পরিচিতি পেয়েছে যেমন শিখনক্রম, শিখন-শেখানো কৌশল, শিখন-শেখানো সামগ্রী ও মূল্যায়ন পদ্ধতি। এসব কিছুর ভিত্তিতেই যোগ্যতা মূল্যায়ন হবে। যোগ্যতার মূল্যায়নের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারণ করে পারস্পরিক সহযোগিতা, সম্মান ও সম্প্রীতি বজায় রেখে ধর্মীয় অনুশাসন, সততা ও নৈতিক গুণাবলি অর্জন করবে। এ ছাড়া গাণিতিক, বৈজ্ঞানিক এবং মানবিক শিক্ষার সমন্বয় কাজে লাগিয়ে দেশকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারবে এবং একজন সৎ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন :নতুন শিক্ষাক্রমে ট্রেডিশনাল পরীক্ষা বাদ দিয়ে মূল্যায়ন হবে। এ মূল্যায়নের প্রধানত দুটি ধাপ একটি শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং সামষ্টিক মূল্যায়ন। এই মূল্যায়ন হবে বছরে ষান্মাসিক ও বাৎসরিক। শিখনকালীন মূল্যায়নের পাশাপাশি রয়েছে আচরণগত মূল্যায়ন। সরাসরি নাম্বার ব্যবস্থা না থাকলেও মূল্যায়ন শেষে নাম্বারে শতাংশ অনুযায়ী যোগ্যতা মূল্যায়ন হবে। প্রতিটি মূল্যায়নে তিনটি সূচক রয়েছে যার মধ্যে সর্বোচ্চ রয়েছে পিরামিড; যে শিক্ষার্থী কাজ নিজে নিজে কারো সাহায্য ছাড়া সম্পূর্ণ করতে পারবে তাকে এই সূচক দেওয়া হবে। এর পরে রয়েছে বৃত্ত; যে শিক্ষার্থী কিছুটা অন্যের সাহায্য নিয়ে কাজটি করবে তাকে এ সূচক দেওয়া হবে এবং শেষে রয়েছে চতুর্ভুজ; যে শিক্ষার্থী তার সহপাঠী এবং শিক্ষকের সাহায্য নিয়ে কাজটি সম্পন্ন করবে তাকে এই সূচক দেওয়া হবে। এভাবে মূল্যায়ন শেষে প্রতিটি শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক বুঝতে পারবে কোন কোন বিষয় নিয়ে তার জটিলতা রয়েছে এবং কোন ক্ষেত্রে তার ঘাটতি রয়েছে এবং কোন ক্ষেত্রে তার পারদর্শিকতা শীর্ষে রয়েছে। ফলে পরবর্তীতে ওই শিক্ষার্থী তার দুর্বলতার জায়গা নিয়ে কাজ করতে পারবে এবং শক্তির জায়গাকে শাণিত করে সে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে। দিন শেষে সেই শিক্ষার ফলে অর্জিত যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে জীবন পরিচালনা করতে পারবে।

সর্বোপরি দেখা যাচ্ছে, লাখ লাখ জিপিএ ফাইভ পেয়ে যেখানে শিক্ষার্থীরা বেকার বসে থাকে সেখানে এখনকার শিক্ষার্থীরা যোগ্যতা অর্জন করে চাকরির প্রতি না ছুটে নিজেই উদ্যোক্তা হয়ে এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে সমাজের একজন কার্যকরী নাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবে। শিক্ষা হবে আনন্দময় ও উপভোগ্য এবং যোগ্যতা থেকে নিজেই স্বাবলম্বী হতে পারবে, একইসঙ্গে অন্যকে সহায়তা করতে পারবে। এভাবেই আমাদের সমাজ বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যথাযথ বিনিয়োগ ও তদারকি চালু রাখলে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যাবে। নতুনত্বের ছোঁয়া নিয়ে বিশ্বের বুকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রতিষ্ঠিত হবে স্বতন্ত্র গুণে গুণান্বিত বাংলাদেশি জাতিসত্তা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে