মাত্র পাঁচ বছর বয়সে যিনি বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে ভাবনা শুরু করেন তিনি আলবার্ট আইনস্টাইন। পদার্থ বিজ্ঞানে এক বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ জার্মানের মিউনিখে। আইনস্টাইন প্রাথমিকে ভর্তি হন ক্যাথলিক স্কুলে। ঠিক সে সময়েই একটি কম্পাস হাতে পান তিনি এবং তার ব্যবহার দেখে বিস্মিত হন। অদৃশ্য শক্তির কারণে কীভাবে কম্পাসের কাঁটা দিক পরিবর্তন করছে? তখন থেকে আজীবন অদৃশ্য শক্তির প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ তৈরি হয়। ১২ বছর বয়সে তিনি জ্যামিতির একটি বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হন। বইটি অধ্যয়ন করে এত মজা পেয়েছিলেন যে একে আজীবন 'পবিত্র ছোট্ট জ্যামিতির বই' বলে সম্বোধন করেছেন। আসলে বইটি ছিল ইউক্লিডের এলিমেন্টস।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ৩ বছর সেখানেই পড়াশোনা করেন। স্কুলে বেশ ভালো ফলাফল করতেন। এরপর ৮ বছর বয়সে তাকে লুইটপোল্ড জিমনেসিয়ামে (বর্তমানে আলবার্ট আইনস্টাইন জিমনেসিয়াম নামে পরিচিত) স্থানান্তরিত করা হয়, যেখানে তিনি উন্নত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। সেখানে ৭ বছর পড়াশোনা শেষে তিনি জার্মান সাম্রাজ্য ত্যাগ করেন। ১০ বছর বয়সে তার ওপর চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক ছাত্র মাক্স টালমুডের বিশেষ প্রভাব পড়েছিল। তাদের বাসায় তিনি মাঝেমধ্যেই নিমন্ত্রণ খেতে যেতেন। এভাবে এক সময় সে আইনস্টাইনের অঘোষিত প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। টালমুড তাকে উচ্চতর গণিত ও দর্শন বিষয়ে শিক্ষা দিত। টালমুড তাকে অ্যারন বার্নস্টাইন লিখিত শিশু বিজ্ঞান সিরিজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এই বইয়ে লেখক বিদু্যতের সঙ্গে ভ্রমণ তথা একটি টেলিগ্রাফ তারের ভিতর দিয়ে চলাচলের অভিজ্ঞতার কথা বলেন। আইনস্টাইন তখন নিজেকে প্রশ্ন করেন, এভাবে যদি আলোর সঙ্গে ভ্রমণ করা যেত তাহলে কী ঘটত? এই প্রশ্নটি পরবর্তী ১০ বছর তার মনে ঘুরপাক খেতে থাকে। তিনি ভেবে দেখেন, আলোর সঙ্গে একই গতিতে ভ্রমণ করলে আলোকে স্থির দেখা যাবে, ঠিক যেন জমাটবদ্ধ তরঙ্গ। দুই বছরের মাথায় তিনি দাবি করেন যে, তিনি সমাকলন এবং অন্তর্কলন ক্যালকুলাস আয়ত্ত করে ফেলেছেন। ১৩ বছর বয়সে যখন তিনি দর্শন এবং সংগীতের প্রতি আরও গুরুতর আগ্রহী হয়েছিলেন টালমুডই তাকে ইউক্লিডের এলিমেন্টস এবং ইমানুয়েল কান্টের ক্রিটিক অফ পিউর রিজন বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এর পরেই কান্ট তার প্রিয় দার্শনিক হয়ে ওঠেন।
আইনস্টাইনের বয়স যখন ১৫ তখন তার বাবা প্রতিনিয়ত ব্যবসায় ক্ষতির শিকার হতে থাকেন। ১৮৯৪ সালে হেরমান এবং জ্যাকবের কোম্পানি মিউনিখ শহরে বৈদু্যতিক আলো সরবরাহের একটি চুক্তিতে হেরে যান। এই ক্ষতির কারণে তারা মিউনিখের কারখানা বিক্রি করতে বাধ্য হন। হেরমান সপরিবারে ইতালির মিলানে পাড়ি জমান। তার বাবা পড়াশোনার জন্য তাকে মিউনিখে একটি বোর্ডিং হাউসে রেখে গিয়েছিলেন। তার বাবা চেয়েছিলেন ছেলে তড়িৎ প্রকৌশলী হবে, কিন্তু তিনি বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। সে সময়েই আইনস্টাইন জীবনের প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লেখেন যার নাম 'চৌম্বক ক্ষেত্রে ইথারের অবস্থা সংক্রান্ত অনুসন্ধান'। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মাত্র ৬ মাস পরেই মিউনিখ ছেড়ে পাভিয়াতে বাবা-মার কাছে চলে যান। হঠাৎ একদিন দরজায় আলবার্টকে দেখে তারা বিস্মিত হয়েছিলেন। তার ওপর স্কুলের চাপের বিষয়টি বাবা-মা বুঝতে পারেন। ইতালিতে তাকে কোনো স্কুলে ভর্তি করাননি তারা। মুক্তজীবন কাটাতে থাকেন আইনস্টাইন।
১৮৯৫ সালে ১৬ বছর বয়সে তিনি জুরিখের সুইজারল্যান্ডীয় ফেডারেল পলিটেকনিক স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ফরাসি ভাষা, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞান বিষয়ে অকৃতকার্য হলেও পদার্থবিজ্ঞান এবং গণিতে তার অর্জিত গ্রেড অতুলনীয় ছিল।
পরে স্নাতক হওয়ার পর আইনস্টাইন শিক্ষকতার কোনো চাকরি খুঁজে পাননি। প্রায় ২ বছর চাকরির জন্য ঘোরাঘুরি করেন। তিনি ১৯০১ সালের ফেব্রম্নয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের নাগরিকত্ব অর্জন করেছিলেন, তবে চিকিৎসা সংক্রান্ত কারণে তাকে কোথাও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কিন্তু ২ বছর ঘোরাঘুরির পর তার প্রাক্তন এক সহপাঠীর বাবা তাকে বার্নে ফেডারেল অফিস ফর ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি নামক একটি পেটেন্ট অফিসে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। তার চাকরি ছিল সহকারী পরীক্ষকের। ১৯০৫ সালে কর্মরত থাকাকালে আইনস্টাইন অহহধষবহ ফবৎ চযুংরশ নামক জার্মান বিজ্ঞান সাময়িকীতে যুগান্তকারী চারটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। জার্মানির নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রগুলোকে ইতিহাসে অ্যানাস মিরাবিলিস গবেষণাপত্রগুলো নামে স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে। গবেষণাপত্র চারটির বিষয় ছিল- ১. আলোক তড়িৎ ক্রিয়া প্রতিপাদন ২. ব্রাউনীয় গতি- আণবিক তত্ত্বের সমর্থন ৩. আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব আবিষ্কার ৪. ভর-শক্তি সমতা- বিখ্যাত ঊ = সপ২ সূত্র প্রতিপাদন। ১৯০৫ সালকে তাই আইনস্টাইনের জীবনের 'চমৎকার বছর' হিসেবে উলেস্নখ করা হয়।