শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিশু নির্যাতন ও হত্যা

এটা সত্য, সমাজের একশ্রেণির বর্বর পাষন্ড মানুষের হাতে অনেকের জীবনই বিপন্ন হয়ে পড়ছে, অবলীলায় জীবন চলে যাচ্ছে। এমনকি শিশুর জীবনও চলে যাচ্ছে। সমাজে শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ঠুনকো কারণে শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। আপনজনের হাতেও শিশুর জীবন চলে যাচ্ছে। কেবল তাই নয়- আমাদের কোমলমতি শিশুরা অবলীলায় নির্যাতন ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। অথচ শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সমাজ তথা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কারণ আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ কান্ডারী। শিশুর সুস্থ বিকাশ কীভাবে হবে, কীভাবে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে- এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের নতুনভাবে ভাবা উচিত। পাশাপাশি অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে।
সালাম সালেহ উদদীন
  ০২ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

যতই দিন যাচ্ছে সমাজে শিশু নির্যাতনের হার বাড়ছে। কেবল নির্যাতন নয়, শিশু হত্যার সংখ্যাও বেড়েছে উদ্বেগজনকহারে। চলতি বছর গড়ে মাসিক শিশু নির্যাতনের হার বেড়েছে ২০ শতাংশ। এমনটাই জানিয়েছে শিশুবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ (সিআরএসিবি)। জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত গড়ে ৪৫৭ জন করে ৩ হাজার ৬৫৩ শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে। অন্যদিকে ২০১৯ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৩৮১ শিশু নির্যাতনের শিকার হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আইনে (নারী ও শিশু আইন ১৯৯৫; সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০) ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃতু্যদন্ড। তবে তার প্রমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেকের। আইন সংস্কার করার পরও হত্যা নির্যাতন কমেনি। এটা সমাজের এক ভয়াবহ চিত্র। আসলে মানুষের মানবতা এবং মনুষ্যত্ব দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। যার ফলে সমাজে নির্যাতিত শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এর মধ্যে বেশ কয়েকটি শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে। যা আমাদের বিবেককে নাড়া দেয় এবং হতাশাবাদী দুঃখবাদী করে তোলে। ঢাকার সাভারে দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন অবস্থায় নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। রোববার দুপুরে সাভারের উত্তর রাজাশন এলাকার এক তিনতলা ভবন সংলগ্ন উন্মুক্ত জায়গা থেকে ওই শিশুর দ্বিখন্ডিত মরদেহ উদ্ধার করে। নিহত নবজাতকের বয়স দুই থেকে তিনদিন। দ্বিতীয় ঘটনা হচ্ছে- রোজিনার কাছে মোবাইল ফোন কেনার টাকা চান মোস্তফা। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়। ঝগড়ার একপর্যায়ে পাঁচ মাসের ছেলে আশিককে দুই পা ধরে ঢেঁকির সঙ্গে আছাড় দিলে ঘটনাস্থলেই তার মৃতু্য হয়। ঘটনাটি ঘটেছে নোয়াখালীতে।

তৃতীয় ঘটনা হচ্ছে- দুজনের বাসা পাশাপাশি। বয়সে এক বছরের ছোট-বড়। খেলার সাথী তারা। কটূক্তি করায় একদিন খেলার একপর্যায়ে মো. শাওনকে (১০) গলা টিপে হত্যা করে তারই বন্ধু ১১ বছর বয়সি আরেক শিশু। এরপর সে লাশটি বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেয়। ওই ভয়ানক হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে। ঘটনাটি চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড থানার আকমল আলী রোডের জেলে পাড়াসংলগ্ন বেড়িবাঁধে।

চতুর্থ ঘনটা হচ্ছে- সাতক্ষীরা সদর থানার হাওয়ালখালী গ্রামের সোহাগ হোসেন ও ফতেমা দম্পতি অত্যন্ত দরিদ্র। তাদের ১৫ দিনের ছেলেসন্তান ঘুমিয়ে থাকা মায়ের পাশ থেকে বৃহস্পতিবার বিকালে চুরি হয়ে গেছে বলে প্রচার করা হয়। ঘটনার পরপরই তদন্ত কাজ শুরু করে পুলিশ। কয়েক দফা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়। শিশুটির বাবা-মায়ের স্বীকারোক্তি মতে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা পর তাদের বাড়ির সেপটিক ট্যাংকের ভেতর থেকে শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় শিশুটির বাবা-মাকে আটক করা হয়েছে। মূলত শিশুটির বাবার চাপে মা শিশুটিকে হত্যা করে টয়লেটের ট্যাংকে ফেলে দেন। হত্যার কারণ হিসেবে তারা বলছেন- শিশুটি জন্মের পর থেকে অসুস্থ। হার্ট ও কিডনিতে সমস্যা। শিশুটিকে রেখে বড় করতে গেলে নিজেরা অসুবিধায় পড়বেন ভেবে পরিকল্পিতভাবে দুজন মিলে তাকে হত্যা করে। এ চারটি ঘটনা পাশাপাশি দাঁড় করালে কী দাঁড়ায়? এর চেয়ে বর্বরতা আর কী হতে পারে। প্রায় শোনা যাচ্ছে বাবা-মা সন্তানকে হত্যা করছে। এ ধরনের ঘটনা সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত নজির।

শিশু নির্যাতন সম্পর্কে মহানবীর (সা.) ভাষ্য : ইসলাম শিশু ও নারী নির্যাতন দমনে শাস্তির নির্দেশনা আরও কঠোর। বিশেষত শিশু নির্যাতনকে ইসলাম জঘন্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেছে। কারণ শিশুর প্রতি স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসাই ইসলামের মৌলিক শিক্ষা। শিশুরা ভুল করলে প্রহার করা ও বকাঝকার বদলে সুন্দর আচরণ ও উত্তম উপদেশ দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। মায়া-আদরের মাধ্যমে শিশুকে শিক্ষা দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন। শিশু নির্যাতন 'চরম সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলার অন্তর্ভুক্ত।' শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতন ও সহিংসতা বর্বরতার চূড়ান্ত নজির। শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতন ও সহিংসতা বন্ধে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও সচেতনতার পাশাপাশি উপযুক্ত পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক প্রতিবাদ ও ন্যায়ের পথে আহ্বানের উদ্যোগ নিতে হবে।

আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন চার্চে শিশুদের ওপর যাজকদের চালানো যৌন নির্যাতনের ভয়াল কাহিনি আমরা প্রায় সবাই শুনেছি। পাশের দেশ ভারতেও ফাঁস হয়ে গেছে প্রভাবশালী ধর্মগুরু নিত্যানন্দের যৌন কেলেঙ্কারির কথা। আমাদের দেশেও মাদ্রাসায় হুজুর কর্তৃক ছাত্রছাত্রীদের যৌন নির্যাতিত হওয়ার ঘটনার খবর কদিন পরপরই পত্রপত্রিকায় আসে। এ সব ক্ষেত্রে দেখা যায় পাপের ও শাস্তির ভয় দেখিয়ে শিশুদের ঘটনা চেপে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কখনো আবার হুজুর নিজের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকেন এভাবে, 'আমার উপর শয়তান ভর করেছিল। এতে আমার কী দোষ'। নির্যাতনকারী নরপশুরা ভালোভাবেই জানে, শিশুদের মনে এই ভয় কতটা প্রবলভাবে কাজ করে। এমন ঘটনা ওই শিশুদের মানসিকভাবে যে আঘাত হানে, সে আঘাত অনেক ক্ষেত্রে তারা সারাজীবনেও কাটিয়ে উঠতে পারে না। একইভাবে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ও সংবেদনশীল কোনো শিশুর মস্তিষ্কে, কোনো কিছু বোঝার মতো বয়স হওয়ার আগেই কোনো ধারণা বা বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়াটাও কিন্তু শিশুদের জন্য কম ক্ষতিকর নয়। এ ছাড়াও বাসাবাড়িতে যে সব শিশু কাজ করে তারাও অনেক সময় ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়। ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে অনেক শিশু জড়িত। শিশুশ্রম বন্ধের ব্যাপারেও সরকারকে কঠোর হতে হবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ধরনের বর্বরোচিত নিষ্ঠুর ঘটনা এর আগেও বেশ কয়েকটি ঘটেছে। এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এ ধরনের জঘন্য প্রবণতা রোধ করতে না পারলে একদিকে যেমন সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে অন্যদিকে শিশুরাও থাকবে নিরাপত্তাহীন। পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনবে। সুতরাং সময় থাকতেই সাবধান হওয়া সমীচীন।

এটা সত্য, সমাজের একশ্রেণির বর্বর পাষন্ড মানুষের হাতে অনেকের জীবনই বিপন্ন হয়ে পড়ছে, অবলীলায় জীবন চলে যাচ্ছে। এমনকি শিশুর জীবনও চলে যাচ্ছে। সমাজে শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ঠুনকো কারণে শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। আপনজনের হাতেও শিশুর জীবন চলে যাচ্ছে। কেবল তাই নয়- আমাদের কোমলমতি শিশুরা অবলীলায় নির্যাতন ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। অথচ শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সমাজ তথা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কারণ আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ কান্ডারী। শিশুর সুস্থ বিকাশ কীভাবে হবে, কীভাবে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে- এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের নতুনভাবে ভাবা উচিত। পাশাপাশি অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় বলতে হয়-

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক'রে যাব আমি

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

অবশেষে সব কাজ সেরে

আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে

করে যাব আশীর্বাদ,

তারপর হব ইতিহাস।

সালাম সালেহ উদদীন : কবি কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে