মুক্ত জ্ঞানচর্চাই অন্ধবিশ্বাস দূর করতে পারে
প্রকাশ | ০৬ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০
অনলাইন ডেস্ক
কোনো কিছু দেখার জন্য আলোর প্রয়োজন। আলো সভাবত দুই রকম। (১) চোখের আলো (২) সূর্য, আগুন ও বিদু্যতের আলো। সূর্য, আগুন ও বিদু্যতের আলো যতই উজ্জ্বল হোক, যদি চোখের আলো বা জ্যোতি না থাকে, তবে সব কিছুই অন্ধকার। সুতরাং কোনো দৃশ্যমান বস্তু দেখতে হলে একযোগে দুটো আলোর প্রয়োজন। এই দুই রকম আলোর যে কোনো একটির ঘাটতি হলে দুনিয়ার সবকিছুই অন্ধকার। আবার এ দু-ধরনের আলো যথাযথ থাকা সত্ত্বেও মানুষ অন্ধ হতে পারে। যদি শিক্ষা বা জ্ঞানের আলো না থাকে। শিক্ষা বা জ্ঞানের আলো এমন এক ধরনের জ্যোতিষ্ক যা প্রতিজন মানুষের থাকা অপরিহার্য বা ফরজ। যদি কোনো মানুষের এ আলো না থাকে, তাহলে তাকে মানুষ বলা তো দূরের কথা, তার স্বভাব চরিত্র হয় ইতর পশুর চেয়েও অধম। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে পড়ে অক্ষরজ্ঞান। জাতিগতভাবে পৃথিবীর সব মানুষ এক মানবজাতি হলেও ভাষা, ধর্ম, অঞ্চল, বর্ণ ইত্যাকার কারণে বিভিন্ন উপজাতিতে বিভক্ত। এই উপজাতিগুলোর মানুষের মধ্যে ভাব আদান-প্রদানের জন্য পৃথক পৃথক ভাষা রয়েছে। এই ভাষার সাহায্যে মানুষ শুধু মনের কথা নয়, অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি, এককথায় জ্ঞানের আলোর সন্ধান করে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষারই বর্ণ বা অক্ষর রয়েছে। এই সাঙ্কেতিক চিহ্ন অক্ষরগুলোই মানুষের জ্ঞানচর্চার চাবিকাঠি। সুতরাং কোনো মানুষ বা মানবসমাজে যদি এই বর্ণ বা অক্ষরজ্ঞান না থাকে, তাহলে তার বা তাদের সামনে কোনো জ্ঞানচর্চার পুঁথি অন্ধকার বলে মনে হবে। সুতরাং অক্ষরজ্ঞানের অভাব জ্ঞানচর্চার পথে প্রধান অন্তরায়। আবার যদি কারও অন্তরে প্রচন্ড জ্ঞানপিপাসা থাকে, তাহলে উলিস্নখিত বাধাগুলো অতিক্রম করা অসম্ভব নয়। এ ধরনের মানুষের চোখ, কান, মেধা ও স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর হয়। জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা যদি কারও অন্তরে বা হৃদয়ে প্রবল থাকে, তাহলে চোখের আলো বা যে কোনো বাহ্যিক আলোর ঔজ্জ্বল্যকেও সে আলো নিষ্প্রভ করে দিতে পারে। পৃথিবীতে অনেক নিরক্ষর বা অন্ধ জ্ঞানীগুণী মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়। তা ছাড়া হাল জ্ঞানবিজ্ঞানের এই উৎকর্ষের যুগে নিরক্ষর বা অন্ধদের জন্য জ্ঞানলাভের সুব্যবস্থা রয়েছে।
সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। আলস্নাহতালা এই মানুষের সুখ-সুবিধা ও আরাম-আয়েশের জন্য অন্যান্য যাবতীয় প্রাণী ও বস্তু সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য, ক্ষমতা, মেধা ও বুদ্ধিমত্তা দান করেছেন, যার সাহায্যে মানুষ সব সৃষ্টির ওপর, সৃষ্টি রহস্যের ওপর জ্ঞানলাভ করে আধিপত্য বা খবরদারী করার একচেটিয়া অধিকার পেয়েছে। এই মানুষ যদি সূর্য, আগুন ও বিদু্যতের আলো, চোখের জ্যোতি, স্মৃতিশক্তি ও মেধার দ্বারা অন্তরের সুপ্ত জ্ঞানপিপাসা নিবৃত করার জন্য কোনো চেষ্টা বা সাধনা না করে, তাহলে সৃষ্টির সেরা জীব, মনুষ্য সৃষ্টি, আলস্নাহতালার বৃথা সৃষ্টি হিসেবে পরিগণিত হবে। আবার এত সব আলো দান করা সত্ত্বেও মানুষ অন্ধ থেকে যেতে পারে। মানুষের অন্ধ থাকার পেছনে আরও একটি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। চোখের জ্যোতি, সূর্য, আগুন বা বিদু্যতের আলোর ক্ষমতা এখানে ব্যর্থ। সাক্ষরতা, লেখাপড়া বা জ্ঞানার্জন এখানে অকার্যকর, যতক্ষণ না সঠিক জ্ঞান বা বিশ্বাসের আলো মন বা হৃদয়কে আলোকিত করতে পারে। জ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত সত্যকে অবিষ্কার করার মতো ক্ষমতা অর্জনই হলো সত্যিকারের জ্ঞান। চিন্তায়, কথায় ও কাজে যিনি বা যারা সত্যনিষ্ঠ, তিনি বা তারাই হলেন প্রকৃত জ্ঞানী। আর প্রকৃত জ্ঞানীর পক্ষেই সম্ভব মুক্তজ্ঞানের অধিকারী হওয়া।
বিশ্বাসের আলো যদি ঘোলাটে হয় কিংবা না থাকে, তাহলে অন্ধবিশ্বাস মানুষকে জ্ঞানপাপীতে পরিণত করে। আগেই বলা হয়েছে, সূর্য, আগুন বা বিদু্যতের আলো থাকা সত্ত্বেও যদি চোখের আলো না থাকে, তাহলে একজন মানুষের জন্য ওইসব আলো হয় অর্থহীন। সেরূপ অন্যান্য আলোও অর্থহীন হয়ে পড়ে, যদি জ্ঞানের আলো না থাকে। আবার সব ধরনের আলো থাকা সত্ত্বেও মানুষ অন্ধই থেকে যেতে পারে, যদি বিশ্বাসের আলোয় অরাজগতা দেখা দেয়। অন্ধবিশ্বাস মানুষকে অন্ধকার জগতে আটকে রাখে, যা মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনে। সুতরাং অন্ধবিশ্বাস সব ধরনের আলোকে নিষ্প্রভ করে যে দিতে পারে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে, এই অন্ধবিশ্বাস বলতে আসলে কি বোঝায়? অন্ধবিশ্বাস সম্পর্কে চমৎকার একটি গল্প বলি। একটুকরা ছাপানো কাগজ পড়ে ছিল রাস্তায়। লোকজন তা মাড়িয়ে চলাচল করছিলেন। একজন হুজুরের তা চোখে পড়ে। তিনি খুবই আদবের সঙ্গে তুলে কপালে ছোঁয়া দিয়ে মুখে চুমু খেয়ে অতি যত্নের সঙ্গে ভাঁজ করে বুকপকেটে রাখতে যাচ্ছিল। একজন শিক্ষক কৌতূহলী হয়ে কাগজ খন্ডটি দেখার জন্য চেয়ে নেন। বেশধারী হুজুর আরবি-উর্দুর অর্থ বোঝা তো দূরের কথা শুদ্ধভাবে পড়তেও পারতেন না। ওই শিক্ষকের মুখেই গল্পটি শোনা। আসলে কাগজ খন্ডটি ছিল পাকিস্তানি চিত্রপুরীর জেবা-মোহাম্মদ আলীর রোমাঞ্চকর খবরের অংশ। আরবি ও উর্দু ভাষার অক্ষর প্রায় একইরকম দেখতে। আর আরবি আসমানি মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআনের ভাষা। হুজুর ওই ভাষায় লেখা কাগজের অবমাননা সহ্য করতে পারেননি। ওই ভাষা যে জাহিলিয়া যুগের নষ্টভ্রষ্টদেরও ভাষা, এটা হুজুরের জানা নেই। তাই অন্ধবিশ্বাসে পবিত্র মনে করে পকেটে রাখতে যাচ্ছিল। মাইকে কথা বলা হারাম বলে একসময় মুসলমানদের অন্ধবিশ্বাস ছিল। এখন অবশ্য মাইক ছাড়া কোনো ধর্মসভা জমে না। বিজ্ঞান শিক্ষা ইসলামবিরোধী বলে এখনো অনেক মুসলমানের অন্ধবিশ্বাস আছে। এরূপ আরও অনেক বিষয়ের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের কোনো বিরোধ না থাকলেও ওইগুলোকে অনেকে ইসলামবিরোধী বলে বিশ্বাস করে। শুধু বিশ্বাসই নয়, অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের কারণে ইসলামের দোহাই দিয়ে সেগুলো মহাপাপের কাজ বলে ঘৃণাসহ বিরোধিতা ও প্রতিহত করার জন্য জেহাদ পর্যন্ত করে। অন্ধবিশ্বাসের কারণে যদি কোনো ধর্মসম্প্রদায় মুক্তজ্ঞানের প্রতি বিদ্বেষী হয়ে ওঠে, বিশ্বাসের আলোকে এড়িয়ে চলে, তাহলে আধুনিক বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষের যুগে প্রযুক্তিজ্ঞানসমৃদ্ধ অপরাপর ধর্মসম্প্রদায়ের সঙ্গে কদম মেলাতে ব্যর্থ হয়ে পদে পদে বিড়ম্বনার সম্মুখীন ও হোঁচট খাওয়াসহ ক্ষতিগ্রস্ত বা পেছনে যে পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আলোকিত মানুষ হিসেবে জীবনের আলো ছড়িয়ে সমাজ, পরিবেশ, জাতি ও বিশ্বের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে হবে। এরূপ সাধনা দ্বারা অজ্ঞ মানবসমাজকে মুক্তজ্ঞানের ঠিকানায় পৌঁছানো সম্ভব হলে মাবনজীবন সার্থক হবে। মহামানবগণের জীবনের আদর্শের আলোর পরশে এভাবে সমাজ-দেশ ও বিশ্বের মানবসমাজ আলোকিত হয়েছে যুগে যুগে। এক বা একাধিক মানুষের অন্ধবিশ্বাসের বলি হয়ে অন্ধকারে যেমন ডুবে গেছে সমাজ-দেশ ও বিশ্ব, তেমনি এক বা একাধিক জীবনের প্রজ্বলিত আলোতে আলোকিত হয়ে উঠেছে সমাজ -দেশ ও বিশ্বের মানুষ।
\হ
আব্দুল খালেক মন্টু
পাবনা